কিংস পার্টি কী, কেন তৈরি হয়, পরিণতি যেমন

দেশের রাজনীতিতে কিংস পার্টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকারের এক বছর নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সংবাদ সম্মেলন থেকে এই আলোচনার সূত্রপাত। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনের একাংশে কিংস পার্টি গঠনের বিষয়ে উল্লেখ আছে। সোমবার এটি প্রকাশের সময় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এই কিংস পার্টি বলতে তারা বুঝিয়েছেন নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি)।
এনসিপিকেই যে প্রথমবারের মতো ‘কিংস পার্টি’ বলা হচ্ছে এমন নয়। সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও কিংস পার্টি নিয়ে আলোচনা ছিল। তখন তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) সহ কয়েকটি দলকে রাজনৈতিক মহলে কিংস পার্টি হিসেবে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়। যদিও সে সময় বিএনএম-এর এক নেতা জনগণের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাদের যেন কিংস পার্টি না ডাকা হয়। কয়েক মাস আগে একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপিকেও কিংস পার্টি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন এনসিপির এক শীর্ষ নেতা।
কিংস পার্টি কী
কোন দলকে কিংস পার্টি বলা যাবে তা নিয়ে একাডেমিক কোনো সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও ইতিহাসভিত্তিক লেখা থেকে এমন দলের বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, গণতন্ত্র, সরকার ব্যবস্থা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা রিপাবলিক পলিসি বলছে, কিংস পার্টি হলো একটি রাজদরবারপন্থী দল। এটি এমন একটি রাজনৈতিক দল, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদের পক্ষে সমর্থন জানায়। এ ধরনের দলের লক্ষ্য থাকে রাজবংশ, উচ্চবর্গীয় অভিজাত শ্রেণি, স্বৈরতন্ত্র ও রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা।
পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডনের ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, কিংস পার্টি বলতে সেই রাজনৈতিক দলকে বোঝানো হয়, যারা অনির্বাচিত শক্তি-যেমন সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ আজ মঙ্গলবার সমকালকে বলেন, কিংস পার্টির আনুষ্ঠানিক কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে এই ধারণার শুরু হয়েছিল স্কটল্যান্ডে, ষোড়শ শতকের দিকে। সে সময় রানীর সঙ্গে তাঁর ছেলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল। এর জেরে রানী পার্লামেন্টের একাংশকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। সেখান থেকে বলা যায়, কিংস পার্টি হলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া একটি দল।
‘কিংস পার্টি’ রাজনীতির ভূত ও ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর সমকালে প্রকাশিত শেখ রোকনের নিবন্ধ অনুযায়ী, ইতিহাসের প্রথম কিংস পার্টি গঠিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই স্টেটে। দ্বীপপুঞ্জটি স্বাধীন ‘হাওয়াই কিংডম’ থাকাকালে নিয়ম ছিল যে, রাজার বংশগত উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তিনি কাউকে মনোনীত না করে গেলে বিধানসভা পরবর্তী রাজা নির্বাচন করবে। ১৮৭৪ সালে কিং লুলালিলোর মৃত্যুর পর এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। রাজকীয় সেনাপ্রধান ডেভিড কালাকাউয়া এবং পূর্ববর্তী রাজা চতুর্থ কামেহামেহার স্ত্রী কুইন এমা নির্বাচনে দাঁড়ান। বিধানসভার সদস্যরা তখন ‘কিংস পার্টি’ ও ‘কুইনস পার্টি’ নামে বিভক্ত হন এবং ৩৫-৬ ভোটে কালাকাউয়া নির্বাচিত হন। জনসাধারণের মধ্যে রানীর প্রভাব বেশি থাকায় নির্বাচনের পর দাঙ্গা বেধে যায় এবং আমেরিকান ও ব্রিটিশ নৌ সেনাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে পরবর্তী দেড় দশকের মধ্যে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং হাওয়াই যুক্তরাষ্ট্রের ‘টেরিটোরি’ হিসেবে ‘যোগ’ দিয়েছিল।
বাংলাদেশে ‘কিংস পার্টি’ ধারণা মুখরোচক হয় ‘ওয়ান ইলেভেন’ বা এক-এগারোর সরকারের সময়। সেই সময় জরুরি অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকলেও রাজনীতিক ও সাংবাদিক ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর নেতৃত্বে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি-পিডিপি’। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৪৫ দিন আগে দলটি নিবন্ধন পায়। অবশ্য ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর নিবন্ধন হারায় পিডিপি। একই সময়ে ২০০৮ সালের ১৭ নভেম্বর নিবন্ধন পেয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি।
এনসিপিকে কেন কিংস পার্টি বলা হচ্ছে
‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শিরোনামে সোমবার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গবেষণা ফলাফলের নির্বাচন সংক্রান্ত ঘাটতি অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল (কিংস পার্টি) গঠনের অভিযোগ আছে।’ এর ব্যাখ্যায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘এটা সবাই জানে যে, এনসিপি হচ্ছে এই কিংস পার্টি। কারণ তাদের দুজন সহযোগী এখন সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে আছেন, আবার একজন উপদেষ্টার পদ ত্যাগ করে এই দলে যুক্ত হয়েছেন।’
এ নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ। তিনি বলেছেন, গণঅভ্যত্থানে অরাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার পর মনে হয়েছে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের সময় দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়া উচিত। সে প্রেক্ষাপটে আমরা যখন দল করেছি তখন সরকারের কাছে থেকে কোনো সহযোগিতা চাইনি। এখনো চাচ্ছি না। গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যারা সরকারে আছেন তারা কেউই এনসিপির জন্য কাজ করছেন না। গণঅভ্যুত্থানের মাঠ থেকে যে ডাক এসেছিল সেটি তারা ‘মিনিমাল স্কেলে’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলছেন, শুরুর দিকে বিএনপিকেও কিংস পার্টি বলা হতো। কিন্তু পরে তারা সাংগঠনিক ও আদর্শের চর্চার মাধ্যমে বড় দলে পরিণত হয়েছে। এনসিপিও যদি তাদের আদর্শ ধরে রেখে ভবিষ্যতেও রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারে তাহলে হয়তো মূল ধারার দল হিসেবে পরিচিতি পাবে।
কয়েকটি ‘কিংস পার্টির’ পরিণতি
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচিতি এবং ১৯২০ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত হওয়া নির্বাচনের ফলাফল ও এর বিশ্লেষণ তুলে ধরে একটি বই লিখেছেন নেসার আমিন। ‘বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল’ শিরোনামের বইয়ে উল্লেখ করেছেন, নির্বাচনের আগে আলোচনায় আসা নতুন রাজনৈতিক দল খুব বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পারে না। ভোটের মাঠে তাদের ফলাফলও খুব বেশি আশাব্যঞ্জক হয় না।
সবশেষ জাতীয় নির্বাচনেও ভরাডুবি হয় কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম এর। এসব দলের হেভিওয়েট নেতা হিসেবে পরিচিত ছয়জনই জামানত হারান। সারাদেশে এই দুই দলের ১৮৭ প্রার্থীর মধ্যে মাত্র একজন জামানত রক্ষা করতে পেরেছিলেন।