ক্রাইম জোন গাজীপুর

♦ মারধরের ভিডিও ধারণ করায় তুহিন খুন, মূল আসামিসহ গ্রেপ্তার চার ♦ দুই ট্রাভেল ব্যাগে মিলল মস্তকবিহীন যুবকের লাশ
ক্রাইম জোন এখন গাজীপুর। খুন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি হামেশাই ঘটছে। আতঙ্কিত করে তুলছে গাজীপুরবাসীকে। শুধু রাত নয়, দিনেও বেপরোয়া অপরাধীরা। গতকাল সকালে গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে দুটি ট্রাভেল ব্যাগের ভিতর মাথাবিহীন লাশের কয়েক খণ্ড টুকরা পাওয়া যায়। বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে নৃশংসভাবে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জিএমপির বাসন থানায় মামলা হয়েছে। তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িত চারজনকে আটক করা হয়েছে। বুধবার বিকালে গাজীপুর সদর মেট্রো থানার কাছে প্রকাশ্যে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনকে পিটিয়ে ও ইট দিয়ে আঘাত করে গুরুতর জখম করা হয়। এ শুধু কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা মাত্র। পুরো গাজীপুরে প্রতিনিয়ত এমন অহরহ ঘটনা ঘটছে। ফলে অপরাধীদের ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকতে হচ্ছে গাজীপুরবাসীকে। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ যে কোনো ধরনের নাশকতা ও সহিংসতা প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গতকাল সকালে গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় দুটি ট্রাভেল ব্যাগে কালো পলিথিনে মোড়ানো মাথাবিহীন আট টুকরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পিবিআই ও সিআইডি আঙুলের ছাপ থেকে লাশের পরিচয় শনাক্ত করে। তাঁর নাম মো. অলি মিয়া (৩৭)। তিনি নরসিংদী সদর উপজেলার কমিরপুর গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে। আজমেরী পরিবহনের হেলপার ছিলেন অলি। তবে তাঁর মাথা এখনো পাওয়া যায়নি। টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশের ধারণা, দুই দিন আগে অলিকে খুন করা হয়। পরে ব্যাগে ভরে বৃহস্পতিবার রাতের কোনো একসময় ঘটনাস্থলে ফেলে যায় খুনিরা। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। নিহতের বড় ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে জিএমপির বাসন থানায় মামলা করেন। মারধরের ভিডিও ধারণ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিক তুহিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ধারণা পুলিশের। তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাসন থানার ওসি শাহিন খান। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) ডিসি (অপরাধ-উত্তর) মো. রবিউল হাসান বলেন, ‘ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রথমে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অভিযুক্তদের শনাক্ত করা হয়। এরপর সালনা এলাকা থেকে চিহ্নিত ছিনতাইকারী কেটু মিজান ও তার স্ত্রী গোলাপিকে আটক করে জিএমপির ডিবি দক্ষিণ। এছাড়া আলামিনকে তুরাগ এলাকা থেকে আটক করে বাসন থানা পুলিশ। আর গাজীপুরের ভবানীপুর থেকে স্বাধীনকে গ্রেফতার করে র্যাব।’ এদিকে সাংবাদিক তুহিন হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন গাজীপুরের সংবাদকর্মীরা। গতকাল সকালে গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক ইউনিয়ন গাজীপুরের উদ্যোগে এ মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন সাংবাদিক ইউনিয়ন গাজীপুরের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। গাজীপুরে কর্মরত বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা এতে অংশ নেন। নিহত তুহিন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামালের ছেলে। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। নিহতের স্ত্রীর বড় ভাই দুলাল হোসেন বলেন, ‘১০ বছরের বিবাহিত জীবনে আমার বোন ফরিদা আক্তারকে কোনো দিন তুহিন ধমক দিয়েছেন বলে শুনিনি। তৌকি (৫) ও ফাহিম (২) নামে তাদের দুই ছেলে রয়েছে।’ নিহতের বড় ভাই মো. সেলিম বলেন, ‘আমার ভাইকে কেন হত্যা করা হলো? তার স্ত্রী ও দুই ছেলে এখন অভিভাবকহীন। হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তি চাই।’ বুধবার বিকালে গাজীপুর মহানগরের সদর থানার কাছে প্রকাশ্যে সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সৌরভকে বেদম মারধর এবং ইট দিয়ে পা থেঁতলে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। হামলাকারীদের কাছে বারবার আকুতি জানিয়েও আনোয়ার রেহাই পাননি। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, রাস্তায় আনোয়ারকে কয়েক দুর্বৃত্ত মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করছে, কেউ লাথি মারছে। কিছু দূর টেনে নেওয়ার পর এক সন্ত্রাসী আনোয়ারের পা ও শরীরে ইট দিয়ে একাধিকবার আঘাত করে। তাঁর বুকের ওপর উঠে লাফাতে থাকে। তিনি দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকায় কাজ করেন। এ ঘটনায় আনোয়ারের মা আনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১৫-২০ জনকে আসামি করে সদর থানায় মামলা করেন। প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই দিন রাতে গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুরে এক ডেকোরেটর ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করে জয়দেবপুর থানা পুলিশ। নিহতের ছেলে সুমন জানান, তাঁর বাবার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি দাঁড় করানো অবস্থায় ছিল। দুর্বৃত্তরা তাঁকে হত্যার পর লাশ এখানে ফেলে গেছে। র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘গাজীপুরের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে র্যাব সদা তৎপর। অপরাধীদের ধরতে অপারেশনাল কার্যক্রম, গোয়েন্দা নজরদারি, চেকপোস্ট ও প্যাট্রলিং নিয়মিত চলছে। সাংবাদিক তুহিন হত্যায় জড়িতদের ধরতে র্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। যে কোনো অপরাধ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে র্যাব সেখানে উপস্থিত হয়। পাশাপাশি ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করে। হাইওয়ের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি।’ গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক বলেন, ‘গাজীপুর জেলায় নিয়মিত চেকপোস্ট ও প্যাট্রলিং এবং বিভিন্ন অপারেশন চালানো হচ্ছে। আমি যোগদানের পর গাজীপুর জেলায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যার রহস্য উন্মোচন করা হয়নি। অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় পরিস্থিত এখন ভালো। খুন, চাঁদাবাজি বা মাদককেন্দ্রিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা সজাগ রয়েছি।’