যে কৌশলে এগুচ্ছে বিএনপি

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা কৌশলে এগুচ্ছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোটদের এক কাতারে রাখতে চাচ্ছে বিএনপি। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দলটি। এমনকি জনগণের ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে সমমনাদের নিয়েই সরকার গঠন করবে। এখান থেকে এক চুলও সরে আসবে না তারা। সমমনাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আহ্বানও জানিয়েছে।
একইসঙ্গে ঐক্য ধরে রাখার উপরেও গুরুত্বারোপ করেছে বিএনপি। সমমনাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, টানাপড়েন ও মতবিরোধ সুরাহা করার পরামর্শ দিয়েছে দলটি। বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা জানিয়েছেন, আন্দোলনের সঙ্গীদের নিয়েই ভবিষ্যতে পথ চলবে বিএনপি। নির্বাচনকে সামনে রেখে সমমনাদের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ৩১ দফা নিয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। ওদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি’র বিরুদ্ধে মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা ছাড়ানোর বিষয়টি বৈঠকে আলোচনা করেছেন নেতারা। এনিয়ে অনলাইন ও অফলাইনে সতর্ক থাকাসহ জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। সামনে দল জোটগুলোর সঙ্গে বিএনপি’র লিয়াজোঁ কমিটি পৃথক পৃথকভাবে বৈঠক করবে। এসব বৈঠকে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
৮ই আগস্ট রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোট নেতাদের সঙ্গে প্রথম দফায় বৈঠক করে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এদিন ২৪টি দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। দ্বিতীয় দফায় ৯ই আগস্ট ১৮টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এরমধ্যে ৮ই আগস্ট সব দলগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে এবং ৯ই আগস্ট পৃথক পৃথকভাবে বৈঠক করেন তারেক রহমান। এসব বৈঠকে বলা হয়, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হলেও নির্বাচন নিয়ে এখনো অনেক ষড়যন্ত্র রয়েছে আলোচনা করেন নেতারা। তাদের ভাষ্য, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে, আছে অনেক বাধাও। এসব মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু মানবজমিনকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের দল এবং জোটদের নিয়ে ভবিষ্যতে আমরা একসঙ্গে চলবো। একইসঙ্গে নির্বাচন ও জাতীয় সরকার গঠন করবো। এ বিষয়টি বৈঠকে বার্তা দিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, গত ১৫ বছর ধরে, বিশেষ করে এক বছর আগে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আগামীতেও এই ঐক্য যাতে অটুট থাকে, সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের ঘোষণার বিষয়েও বৈঠকে আলাপ-আলোচনায় উঠে এসেছে বলেও জানান তিনি।
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বৈঠকে বলা হয়েছে, সরকার সংস্কারের কথা বলছে। কিন্তু তিন বছর আগে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোটগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা ঘোষণা করেছে। সামনে সবাই একসঙ্গে ৩১ দফা নিয়ে জনগণের যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। খুব শিগগিরই ৩১ দফা নিয়ে তারা মাঠে নামবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ওদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মধ্যদিয়ে নির্বাচনী ট্রেনে উঠেছে দেশ। এরইমধ্যে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন এবং তৎপরতাও বাড়িয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। সমমনাদের সঙ্গে বৈঠকে কেউ কেউ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি আলোচনায় তোলেন। কিন্তু এ বিষয়ে বৈঠকে তেমন আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে সমমনা দল ও জোটগুলোর সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে বৈঠক করবে বিএনপি। সেখানে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা হবে।
বাংলাদেশ এলডিপি’র চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, এই বৈঠক নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট। ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপি’র যে প্রতিশ্রুতি সেখান থেকে তারা সরে আসবে না বলে জানিয়েছে। বৈঠকে সবাই একমত পোষণ করেছেন। শিগগিরই যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোটগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে বিএনপি আলোচনায় বসবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, বিএনপি নির্বাচন ও জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে বিএনপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে বৈঠকে জানিয়েছে। সেখান থেকে তারা এক চুলও সরে আসবে না। এ ছাড়া বিএনপি’র বিরুদ্ধে মিডিয়ায় তথ্য সন্ত্রাস হচ্ছে, বিষয়টি কঠোর হস্তে দমনের পরামর্শ দেয়া হয়।
অন্যদিকে বৈঠকে ৩১ দফা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলা হয়। বলা হয়, অনেক মতবিরোধ আসবে, এরপরও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। না হলে ফ্যাসিবাদ সুযোগ পাবে। বৈঠকে নেতারা বলেন, বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোটগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, সামনেও রাখবে। এরপরও ষড়যন্ত্র চলছে, নির্বাচন নিয়েও ষড়যন্ত্র হচ্ছে- এসব ষড়যন্ত্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্যই হচ্ছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বৈঠকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সময় ঘোষণা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আন্দোলনের সময় গণতন্ত্র মঞ্চের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। যুগপৎ আন্দোলনের সবাইকে নিয়েই বিএনপি নির্বাচন এবং জাতীয় সরকার গঠন করতে চায় বলেও জানান তিনি। বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের কিছু কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। সামনে এগুলো কমিয়ে আনার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয় বৈঠকে। বৈঠকটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে হয়েছে। সামনে আরও যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোটের সঙ্গে বিএনপি’র ঘন ঘন বৈঠক হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, বৈঠকটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে হয়েছে। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। যে কারণে বৈঠকটি অত্যন্ত ইতিবাচক হয়েছে। বৈঠকে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য ধরে রাখার ওপরে জোর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, একে-অপরের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলে ফ্যাসিবাদ সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোটদের সঙ্গে বিএনপি ভবিষ্যতে চলতে চায়। আর বিএনপি’র যে প্রতিশ্রুতি, সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সবাইকে নিয়ে আগামী নির্বাচন ও জাতীয় সরকার গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।