আওয়ামী লীগের সময়ে গত বছর ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে: যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্ট

২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশে ভয়াবহভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলের সদস্যরা (বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ) নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট ও গুলি চালিয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বাংলাদেশ অংশে এসব কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেও কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এসব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে রিপোর্টে। ‘বাংলাদেশ ২০২৪ হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট’ শীর্ষক দীর্ঘ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর আগস্টে টানা কয়েক সপ্তাহের ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যুবসংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে শত শত মানুষের মৃত্যু হওয়ার পর, ৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। ৮ই আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। আগস্টে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও মানবাধিকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়। তবে কিছু উদ্বেগ রয়ে গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো হলো- মূলত পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ছিল অবৈধ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, অমানবিক ও অপমানজনক আচরণ বা শাস্তি; নির্বিচার গ্রেপ্তার বা আটক; বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দমননীতি; মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যম স্বাধীনতায় কঠোর বিধিনিষেধ। এর মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, অযৌক্তিক গ্রেপ্তার বা মামলাসহ সেন্সরশিপ অন্তর্ভুক্ত; শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতায় গুরুতর বাধা; শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা হুমকি; এবং সর্বোচ্চ খারাপ ধরনের শিশুশ্রমের বিস্তার। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে ব্যাপক দায়মুক্তির ঘটনা ঘটেছে। তবে সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক সরকারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে। মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমের নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনে ২০২৫ সালের জুলাই ও আগস্টে সাবেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিসংঘের সঙ্গে সমন্বয় করে এবং দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল উভয় ব্যবহার করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনে। এতে আরও বলা হয়, বছর জুড়ে বহু রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, পূর্ববর্তী সরকার বা তাদের এজেন্টরা অবৈধ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। পূর্ববর্তী সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মোট কতোজন নিহত হয়েছে তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি এবং এসব ঘটনার তদন্তেও স্বচ্ছ পদক্ষেপ নেয়নি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই কাজ শুরু করে। পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছিল, সেসব ক্ষেত্রে দোষীদের সাধারণত প্রশাসনিক শাস্তি দেয়া হয়।
বছর জুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, মাদকবিরোধী অভিযান এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বহু সন্দেহজনক মৃত্যু ঘটে। বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলনের সময় তা ব্যাপক আকারে দেখা যায়। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি অক্টোবর মাসে জানায়, ১৬ই জুলাই থেকে ৯ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৯৮৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ছাত্র, শিশু, রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক ও পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। প্রমাণিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলের সদস্যরা (বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ) নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট ও গুলি চালিয়েছে।
২৪শে সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিক্ষোভসংক্রান্ত ৭০৮টি মৃত্যুর প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে এবং তথ্য হালনাগাদে জনসাধারণের সহায়তা চায়। ২০শে সেপ্টেম্বর ‘স্টুডেন্টস এগেইনস্ট ডিসক্রিমিনেশন’ নামে বিক্ষোভ সমন্বয়কারী সংগঠনের স্বাস্থ্য কমিটি দাবি করে, ওই অস্থিরতায় ১,৪২৩ জন নিহত এবং ২২,০০০ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। মোট নিহতদের ৭০ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের কম, এবং তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ ছাত্র। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ছিল ১০৭ শিশু, ৬ জন সাংবাদিক ও ৫১ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।
জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের হার প্রায় আগের বছরের মতোই ছিল। দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, ছাত্র আন্দোলনের নিহতদের বাদ দিয়ে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অভিযোগ অনুযায়ী ১৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বা হেফাজতে মারা গেছেন। এর মধ্যে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ‘সংঘর্ষে’ ৩ জন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ ১ জন, হেফাজতে আত্মহত্যা করেছে ১ জন এবং ১২ জন হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অভিযোগ অনুযায়ী ১২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘ক্রসফায়ারে’ ২ জন, সরাসরি গুলিতে নিহত ১ জন, হেফাজতে মারা গেছে ৩ জন এবং হেফাজতে নির্যাতনে মারা গেছে ৬ জন।
বছর জুড়ে মজুরি বকেয়া, বেআইনি বা অনিয়মিত কারখানা বন্ধ, ছাঁটাই, চাকরিচ্যুতি এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন খাতে কাজ বন্ধ, ধর্মঘট ও অন্যান্য শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে। যেসব কারখানায় ৫০ জনের বেশি কর্মী আছে সেখানে শ্রমিক অংশগ্রহণ কমিটি বা ওয়ার্কার পার্টিসিপেশন কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু মালিকদের হস্তক্ষেপে এসব কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। আইনে নির্বাচন দিয়ে সদস্য বাছাইয়ের কথা থাকলেও, অনেক মালিক নিজেরাই সদস্য নিয়োগ দেন। আইন অনুযায়ী, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিকের সংগঠন গঠন ও সামষ্টিক দরকষাকষির অধিকার সীমিত। ২০২২ সালের ইপিজেড শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী, কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে পরিদর্শনের আগে বেপজা চেয়ারম্যানকে পূর্ব নোটিশ দিতে হয়। এ বছর তারা এপিজেড কারখানায় ১১০টি কারখানা পরিদর্শন করে। পূর্ববর্তী সরকার সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, সামষ্টিক দরকষাকষির অধিকার এবং ধর্মঘটের অধিকার সংরক্ষণের আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারেনি। অন্য নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের শাস্তির তুলনায় অন্যায় শ্রম অনুশীলন ও ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্যের জন্য নির্ধারিত শাস্তি ছিল অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে শাস্তি প্রয়োগ করা হলেও তা প্রায়শই নিয়োগকর্তার বদলে দোষী হিসেবে বিবেচিত শ্রমিকদের বিরুদ্ধেই আরোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম, অপহরণ, আটকের শিকার বিরোধী নেতাকর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীরা: বাংলাদেশে পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি কর্তৃপক্ষ বা তাদের পক্ষ থেকে জোরপূর্বক গুমের ঘটনাও ঘটেছে। নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা গুম ও অপহরণে অব্যাহতভাবে জড়িত ছিলেন। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, তিনজন জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন। আটজনকে অবৈধভাবে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আটক রেখে পরে মুক্ত বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পূর্ববর্তী সরকার এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ, তদন্ত বা শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সীমিত উদ্যোগ নিয়েছে। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো জানিয়েছে, গুমের বেশির ভাগ ভুক্তভোগীই রাজনৈতিক বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বী। গুমের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু ব্যক্তিকে বিনা অভিযোগে মুক্তি দিয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করেছে। অনেককে রাখা হয় গোপন কারাগারে। স্থানীয়ভাবে তা আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত। রিপোর্টে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে জোরপূর্বক একটি গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আসলাম সেরনিয়াবাত নামে এক অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের কর্মকর্তার স্বজনরা অভিযোগে বলেন, ২৯শে আগস্ট ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইউনিফর্ম পরা সদস্য ও সাদাপোশাকধারীরা মিলে তাকে অপহরণ করে। ২৫শে সেপ্টেম্বর পুলিশ তাকে একটি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে আদালতে হাজির করে। সরকার পরিবর্তনের পরপরই বহু গুমের শিকার ব্যক্তিকে গোপন বন্দিশাল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। সেখানে কেউ কেউ টানা আট বছর পর্যন্ত আটক ছিলেন। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় গোপন আটক থাকার পর মুক্তি পান পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী ও অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাবে আরও প্রায় ১০০ জন জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। ফ্রিডম হাউসের ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৪ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অপহরণ এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর মধ্যে মাদক ব্যবসা, সংঘটিত অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানও অন্তর্ভুক্ত।’
আগস্ট মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘বাংলাদেশ কমিশন অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ গঠন করে। এর দায়িত্ব ছিল ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্ত করা। প্রথমে কমিশনকে ৪৫ দিনের জন্য দায়িত্ব দেয়া হলেও পরে তদন্ত সম্পূর্ণ করার জন্য অতিরিক্ত সময় দেয়া হয়। নভেম্বরের শুরুতে কমিশন ঢাকার ভেতরে ও আশপাশে আটটি গোপন বন্দিশিবির শনাক্ত করে এবং ১৬০০টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশের সংবিধান ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেপ্তার ও আটক নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার ও আটক করতে পারে যদি তারা মনে করে যে, ওই ব্যক্তি নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হতে পারেন, অথবা গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকতে পারেন। প্রায়শই কর্তৃপক্ষ আটক ব্যক্তিদের কয়েকদিন গোপনে রাখতো। পরিবারের সদস্য বা আইনজীবীদের কাছে তাদের অবস্থান বা পরিস্থিতি প্রকাশ করা হতো না। এমনকি গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্বীকারও করতো না। সংবিধানে যে কোনো ব্যক্তির আদালতে তার গ্রেপ্তার বা আটকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার অধিকার আছে। পূর্ববর্তী সরকার সাধারণত এই সাংবিধানিক শর্ত মানেনি। তবে নভেম্বর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই বিধান মেনে চলা শুরু করে। সংবিধান অনুযায়ী গ্রেপ্তার ও আটক অবশ্যই ওয়ারেন্টের মাধ্যমে বা অপরাধ সংঘটিত হতে দেখা গেলে হতে হবে। তবে আইনে এই সুরক্ষাগুলোর ব্যাপক ব্যতিক্রম অনুমোদিত। সংবিধান অনুযায়ী, আটক ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারিক কর্মকর্তার সামনে হাজির করে অভিযোগ গঠন করতে হবে। কিন্তু এটি নিয়মিতভাবে কার্যকর করা হয়নি। সরকার বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে কাউকে ৩০ দিনের জন্য আটক করার নির্দেশ দিতে পারেন। তবে কর্তৃপক্ষ প্রায়ই নির্বিঘ্নে আরও দীর্ঘ সময় ধরে আটক রেখেছে। দেশে কার্যকর জামিন ব্যবস্থা থাকলেও, পুলিশ নিয়মিতভাবে জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অন্য মামলায় পুনরায় গ্রেপ্তার করেছে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নতুন মামলায় কাউকে আদালতে হাজির না করেই পুনরায় গ্রেপ্তারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সাধারণত কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে অভিযোগ গঠনের পরেই আসামির আইনজীবীদের তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দিতো, যা কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক গ্রেপ্তারের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর ঘটতো।
আটক ব্যক্তিরা আইনগতভাবে আইনজীবীর সাহায্য পাওয়ার অধিকারী ছিলেন, এমনকি তারা যদি এর খরচ বহন করতে না পারেন তবুও। কিন্তু এই সেবা দেয়ার জন্য দেশে পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না। রিপোর্টে আরও বলা হয়, বহু আটক ব্যক্তিকে বন্দিদশার বাইরে অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হতো না। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বা বক্তব্য, কথিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অংশ হিসেবে মাঝে মাঝেই খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সরকার বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটক রেখেছে। কখনো কখনো অন্য সন্দেহজনক ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য এসব আটক করা হতো। মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীরা বলেন, পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে থাকা পুলিশ বাহিনী বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের টার্গেট করে মিথ্যা মামলা করতো। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনপীড়ন করতে আইনপ্রয়োগকারী এজেন্সিকে ব্যবহার করতো সরকার। পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের অব্যাহতভাবে খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার করতে থাকে। জানুয়ারিতে বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র সদস্যদের অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। তারা বলেন, জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ববর্তী সরকার বিএনপি’র সমর্থক ও বিরোধী রাজনীতিকেরকে বানোয়াট অভিযোগে বড় আকারে দমনপীড়ন চালাচ্ছে। তারা দাবি করেন, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই বিএনপি’র কমপক্ষে ২০ হাজার সদস্যকে জেলে রাখা হয়েছে। তবে ওই সরকারের কর্মকর্তারা দাবি করেন এই সংখ্যা অনেক কম। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অগ্নিসংযোগের মতো সুনির্দিষ্ট ক্রিমিনাল অভিযোগে। বিচার কার্যক্রম শুরুর আগে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা না মেনে সাজানো আটকের ঘটনা চলতেই থাকে।