হাসিনাসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে সেই সুখরঞ্জন বালির অভিযোগ

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে অভিযোগ দায়ের করেছেন পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি। জামায়াত নেতা প্রয়াত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে গুম হয়েছিলেন তিনি। গতকাল প্রায় এক যুগ আগে গুম, অপহরণ, নির্যাতনসহ প্রায় পাঁচ বছর ভারতে অবৈধভাবে কারাবন্দি করে রাখার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তিনি এ অভিযোগ করেন। অভিযোগে শেখ হাসিনার ছাড়াও উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন- সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক এটিএম ফজলে কবির, ট্রাইব্যুনালের সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সাবেক এমপি একেএম আউয়াল, সাবেক চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত ও তৎকালীন তদন্ত সংস্থার প্রধান মো. সানাউল হক।
সুখরঞ্জন বালি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন। তিনি ২০১২ সালের ৫ই নভেম্বর ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে নিখোঁজ হন। তার ভাই বিশাবালিকে (বিশেশ্বর বালি) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন তার কাছে পিরোজপুরের পাড়েরহাটের রাজলক্ষ্মী স্কুলে ডেকে বিশাবালির হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চায়।
সুখরঞ্জনের অভিযোগ, তিনি প্রকৃত ঘটনা খুলে বললেও হেলাল উদ্দিন তাকে বিশাবালির হত্যাকারী হিসেবে প্রকৃত হত্যাকারীদের নামের সঙ্গে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নামও বলতে বলেন এবং তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেন। তিনি রাজি না হলে তাকে তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমপি একেএম আউয়াল, পৌর মেয়রসহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নানারকম চাপ ও হত্যার হুমকি দিতে থাকেন। তাদের কথামতো সাক্ষ্য না দিলে আগামীকালই আমার জীবনের শেষদিন বলে শাসিয়ে চলে যায়। পরে আমি আত্মগোপনে চলে যাই।
পরে, সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশাবালি হত্যার প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। আমি তাকে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলি। তখন তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে সত্য ঘটনা বলার জন্য অনুরোধ করলে, আমি সাক্ষ্য দিতে রাজি হই।
তিনি বলেন, ২০১২ সালের ৫ই নভেম্বর এডভোকেট মিজানুল ইসলামের গাড়িতে করে সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ট্রাইব্যুনালের মূল গেটের কাছে এসে বিপুলসংখ্যক পুলিশ দেখতে পাই। আমাদের গাড়ি আটকে দেয়া হয় এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাদা পোশাকে থাকা অনেক লোক এবং পুলিশ মিলে আমাদের গাড়ি ঘিরে ফেলে। ওরা আমাকে গালি দিয়ে বলে, তোকেই তো আমরা খুঁজছি। নাম নিচে নাম। তারা আমার কানের নিচে প্রচণ্ড জোরে থাপ্পড় মারে। শার্টের কলার ধরে মারতে মারতে জোরপূর্বক একটা সাদা রঙের পুলিশ পিকআপে তুলে দেয়। গাড়িতে উঠিয়েই তারা আমার চোখ ও হাত বেঁধে ফেলে। আমাকে অজানা একটি স্থানে নিয়ে, জানালাবিহীন অন্ধকার ঘরে প্রায় দুই মাস বন্দি করে রাখে। পরে আমাকে একটি কক্ষে নেয়া হয়। সেখানে ক্যামেরা ও আলো ছিল। তারা সাঈদীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করতে চায়। তারা আমাকে কোটি টাকা ও একটি বাড়ি দেয়ারও প্রস্তাব করে। কিন্তু আমি রাজি নাহলে, আমাকে দিনের পর দিন বৈদ্যুতিক শক, শারীরিক নির্যাতন করে।
তিনি বলেন, একদিন চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে কয়েক ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রার পর আমি বাথরুমে যাওয়ার কথা বল্লে তারা খুলে দিলে দেখতে পাই আমাকে সীমান্ত এলাকায় আনা হয়েছে। সেখান থেকে বিজিবি’র সহায়তায় আমাকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার স্বরূপনগর থানার অন্তর্গত বৈকারী বাজার সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে তুলে দেয়া হয়। বিএসএফ আমাকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই নির্মমভাবে মারধর করে, আমাকে হাত বেঁধে নির্যাতন করে। পরে তারা আমাকে বশিরহাট নিয়ে যায়। বশিরহাট সাবজেলে ২২ দিন রাখার পর সেখান থেকে দমদম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় এবং সেখানে আমাকে মোট ৫ বছর আটক রাখে। পরে, মানবাধিকার সংস্থা ও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সহায়তায় আমি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরলেও নিরাপত্তার অভাবে আত্মগোপনে ছিলাম।
অভিযোগে তিনি আরও বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে করা মামলা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সাজানো। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার ভাইকে হত্যার ঘটনা দেখেছি সেখানে সাঈদী হুজুর ছিলেন না। তাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারও পরিকল্পিতভাবে কারাগারে আটকে রেখে হত্যা করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল বলে অভিযোগে উল্লেখ করেন। তিনি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় অপহরণ, গুম এবং ৫ বছর অবৈধভাবে কারাবন্দি রাখাসহ তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব অন্যায়ের বিচার চান।
উল্লেখ্য, মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দেয় তৎকালীন অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মাওলানা সাঈদী আবেদন করলে ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেয়। তাতে সাজা কমে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ আসে। তারপর থেকে তিনি কারাবন্দি ছিলেন। বন্দি অবস্থায় ২০২৩ সালের আগস্টে তিনি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান।