প্রশাসনের চাপে ৪ বার বদলানো হয় আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন: চিকিৎসকের জবানবন্দি

রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলাম তার প্রাথমিক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন- আবু সাঈদ শটগানের পিলেটের আঘাতে মারা যান। কিন্তু বিভিন্ন চাপ ও মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে ৪ বার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে তাকে বাধ্য করা হয় বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। তাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণের প্রলোভন ও পাসপোর্ট না থাকায় দুই সপ্তাহের জন্য কক্সবাজারে ঘুরে আসতে বলে ভুয়া রিপোর্ট তৈরিতে চাপ দেয়া হয় এই চিকিৎসককে। গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এই সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এদিন ৩ সাক্ষী তাদের জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ডা. রাজিবুল ইসলাম এ সাক্ষ্য দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গতকাল সকালে আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ও সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়।
এদিন, শাপলা চত্বর গণহত্যা মামলায় সাবেক আইজিপি শহিদুল হকসহ গ্রেপ্তার ৪ জনকে ১ দিন করে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয় ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় গ্রেপ্তার বাকি তিন আসামি হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ও পুলিশের সাবেক উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোল্যা নজরুল ইসলাম।
এ ছাড়া, মেহেরপুরে জামায়াত নেতা তারিক মো. সাইফুল ইসলাম হত্যার অভিযোগে সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এদিকে, গুমের মামলায় শেখ হাসিনা ও জিয়াউল আহসানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে আগামী ২৬শে অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
সাক্ষীর জবানবন্দি: সাক্ষী ১, গত বছরের ১৬ই জুলাই বুক ও পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছিলেন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল পুলিশের ছররা গুলির আঘাত। রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত মো. গিয়াস উদ্দিন। তিনি জানান, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাদের মেডিকেল কলেজের অফিসে গিয়ে ময়নাতদন্ত সংক্রান্ত দু’টি বই জব্দ করেন। এরপর বই দু’টি বিভাগীয় প্রধান ডা. রাজিবুল ইসলামের জিম্মায় প্রদান করেন। তিনি বলেন, আবু সাঈদ নামের একজন মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এই বই থেকে তারা ফটোকপি করেন।
সাক্ষী-২, এদিন ১৮তম সাক্ষী হিসেবে রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, প্রথমে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত যথানিয়মে সম্পন্ন করি। ময়নাতদন্তে আবু সাঈদের শরীরে বিভিন্ন স্থানে অনেক পিলেটবিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে আবু সাঈদ মৃত্যুবরণ করেছে মর্মে আমি মতামত দিয়েছি। সেখানকার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে উক্ত রিপোর্ট জমা দিতে যাই। কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে রিপোর্ট গ্রহণ না করে পুনরায় রিপোর্ট তৈরি করতে বলে।
পরে রিপোর্ট দ্বিতীয়বারও ভাষাগত পরিবর্তন করে পেশ করি। কিন্তু এটিও না নিলে তৃতীয় রিপোর্টও পেশ করি। চতুর্থবার রিপোর্ট দেয়ার আগে ৩০শে জুলাই রংপুর মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের (মাহফুজুর রহমান) রুমে আমাকে ডেকে নেয়। সে সময়ে ডিজিএফআই, সিটিএসবি, পুলিশের ডিসি ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি (রংপুর) ডাক্তার চন্দন উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় রুমের বাইরে অবস্থান করছিলেন ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা। তারা আমাকে বুলেট ইনজুরির পরিবর্তে হেড ইনজুরি মতামত ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করার চাপ দেন। তাদের মনমতো রিপোর্ট না হলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলে হুমকি দেন। তারা আরও বলেন, আপনার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে, তারা আমাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেখায়। তখন আমি বলি আমার পাসপোর্ট নেই, তারা আমাকে দুই সপ্তাহের জন্যে কক্সবাজার ঘুরে আসতে বলে, আমি বলি আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সারা বিশ্বে লাইভে সমপ্রচারিত হয়েছে।
তিনি জবানবন্দিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, আবু সাঈদ শটগানের পিলেটের আঘাতে মারা যান। কিন্তু বাইরে থেকে চাপ দিয়ে চারবার ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয় তাকে। চাপে পড়ে পঞ্চমবারের প্রতিবেদন দিয়েছেন তিনি। কিন্তু পুলিশ একটি রিপোর্ট নষ্ট করে ফেলতে বলায় আমি ৪টি রিপোর্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দাখিল করেছি।
তিনি আরও বলেন, রংপুরের স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি আমাকে বিভিন্নভাবে চাপ দেন। ডাক্তার চন্দন আমাকে বলেন, আবু সাঈদের লাশ নিয়ে ব্যবসা চলছে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) এ ব্যাপারে কনসার্ন আছেন। পুলিশ যেভাবে রিপোর্ট চায় সেভাবে রিপোর্ট দিয়ে দাও। তোমার বিষয়টা আমরা দেখবো। এত কিছুর পরেও আমি আমার অবস্থান থেকে সরে আসি নাই। আমি কোনো হেড ইনজুরি পাইনি। সর্বশেষ চতুর্থ বার আমার প্রদত্ত রিপোর্ট ইনজুরির বর্ণনা ঠিক করলেও গানশট ইনজুরির কথা উল্লেখ করিনি। পিলেট ইনজুরিসহ অন্যান্য বর্ণনা দিয়ে রিপোর্ট পেশ করি। তারপর তারা সেটি নিয়ে যায়।
সাক্ষী-৩, প্রসিকিউশনের ১৯তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন কুষ্টিয়ার স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক শরীফুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত বছরের ১৮ই জুলাই কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস বিমান মোড় এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হেলমেটধারীরা পুলিশি পাহারায় হামলা করে। পরে, ৪ঠা আগস্ট আন্দোলনের সময় আমরা খবর পাই চৌড়হাস এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ আক্রমণ করেছে। তখন আমরা সেখানে যাই। আমাদের উপস্থিতি বেশি থাকায় আক্রমণকারীরা চলে যায়। তখন আমরা আবার মজমপুর গেটে ফেরত আসি।
পরে, ৫ই আগস্ট রকশি গলি মোড়ে সমবেত হয়ে থানার মোড়ের দিকে যাওয়ার সময় এন এস রোডে জেলা পরিষদের কাছে মৌবন রেস্টুরেন্টের সামনে উপস্থিত হলে এস আই মোস্তাফিজসহ ৮-১০ জন হেলমেটধারী আমাদের ওপর শটগান দিয়ে গুলি শুরু করে। ওই সময় আমার দুই হাতে গুলি লাগে। আমি তখন একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার আন্দোলন শুরু করার জন্য মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মা-খালাসহ সবাইকে ডাকি আন্দোলনে আসতে।
তিনি বলেন, আমরা শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবরটা কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলি এবং গুলি চালাতে নিষেধ করি। তখন ওসি সাহেব হ্যান্ডমাইক দিয়ে আমাকে বলে ছাত্র-জনতাকে শান্ত করতে। ওই সময় এসআই মোস্তাফিজ আমাকে শটগান দিয়ে গুলি করতে থাকে। আমাকে দুজন ছাত্র ডাকবাংলোর ভেতরে নেয়। পরে আমাকে চিকিৎসার জন্য তোফাজ্জল হেলথ সেন্টারে নিয়ে যায়। আমার দুই হাতে ৩ বার অপারেশন হয়েছে। ৬২টা পিলেট বের করা হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছেন, আমার শরীরে আরও ৫০০’র অধিক পিলেট রয়েছে, যা বের করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ৫ই আগস্ট কুষ্টিয়া শহরে ৬ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। সন্ধ্যার পর আনন্দ মিছিল করে ফেরার পথে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের লোকজন কুপিয়ে আরও দুই ছাত্রকে হত্যা করেছে।