ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, প্রস্তুত দেশ

রোহিঙ্গা : অংশীজন সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস * ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বর্তমানে বাংলাদেশ যথেষ্ট স্থিতিশীল ষ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে অন্তর্বর্তী সরকার * ৪০ দেশের প্রতিনিধি সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপের সাত প্রস্তাব
অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। বিগত সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে এক বছর আগে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞ এবং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বর্তমানে দেশ যথেষ্ট স্থিতিশীল। দেশ পুরোপুরি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। গতকাল সোমবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অংশীজন সম্মেলনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
রোহিঙ্গা সংকটকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আরো জোরালোভাবে তুলে ধরতে, কক্সবাজারে ‘স্টেকহোল্ডার্স’ ডায়ালগ: টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রোহিঙ্গা ইস্যুবিষয়ক হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভের দফতর যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে অংশ নিচ্ছেন জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সক্রিয় সব স্টেকহোল্ডারসহ অন্তত ৪০টি দেশের প্রতিনিধি। প্রধান উপদেষ্টা স্থানীয় হোটেল বে ওয়াচে সংলাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা এখন আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আছি। এক বছর আগে আমরা এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।’
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাকে অপরিহার্য উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আসিয়ান, প্রতিবেশী দেশগুলোকে আরো সক্রিয়ভাবে রাখাইন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে মানবপাচার, মাদক চোরাচালান ও ক্ষুদ্র অস্ত্রের অবৈধ ব্যবসার মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনেও উদ্যোগী হতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘২০১৭ সালের এই দিনে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে নিজের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে চলে আসে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এখনো আমরা নতুন করে রোহিঙ্গাদের আগমন দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন। এ রকম একটা দিনে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ইতিহাসের সঠিকপথে অবস্থান নেয়া এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীকে জাতিগত নিধন বন্ধ করানো।’ তিনি বলেন, ‘এটা সাংঘাতিকরকমের ভুল হয়ে যাবে যদি আমরা রাখাইন সম্প্রদায়ের শেষ চিহ্নটুকু দেখার জন্য অপেক্ষা করি। আমরা তা করতে দিতে পারি না। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি আছে। যখন গত মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিব এসেছিলেন এখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে, তিনি অন্য সবার মতো উপবাস ছিলেন এবং প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন। এর মাধ্যমে তাদের একটা আশা দিয়েছিলেন, বিশ্ব তাদের পাশে আছে এবং তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে সাহায্য করবে এবং ঈদুল ফিতরের মতো ধর্মীয় উৎসব নিজ দেশে উদযাপন করতে পারবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের চোখে এখনো ভীতি দেখি, যখন তারা তাদের ওপর হয়ে যাওয়া অবর্ণনীয় ঘটনাগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেন। ২০১৭ এবং তারও আগে বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের এমন পরিস্থিতিতে আমরা চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। আন্তর্জাতিক মহলের এখানে আগের চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করা প্রয়োজন। আমি আন্তর্জাতিক সংস্থা, অংশীজন, দাতাসংস্থাগুলোর অব্যাহত প্রচেষ্টার প্রশংসা করি। আপনাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা রোহিঙ্গাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি যতদিন না তারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছে; যে কারণে কক্সবাজার এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বছর ২২ হাজার শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে। পাঁচ লাখের কম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বর্তমানে মিয়ানমারে অবস্থান করছে। এই চিত্র প্রমাণ করে যে প্রতিনিয়ত নিপীড়নের কারণে রোহিঙ্গারা সে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। গত আট বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে এই কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষ উল্লেখযোগ্য ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমাদের অর্থনীতি, সম্পদ, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান, সমাজ এবং সুশাসনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদকে আর ব্যবহার করার কোনো সুযোগ দেখছি না। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং টেকসই সমাধান বৈশ্বিক অ্যাজেন্ডায় জিইয়ে রাখতে হবে যতদিন না তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত কাজ করছে। এই সংলাপ রোহিঙ্গাদের আওয়াজ আরো জোরালো করছে ও দ্রুত, টেকসই এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ তৈরি করছে। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান শুধু বাংলাদেশের একার কাজ নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এখানে এগিয়ে আসতে হবে।’
এ সময় প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ তৈরিতে সাতটি প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তার প্রস্তাবগুলো হচ্ছে প্রথমত, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদে ফিরে যেতে হবে। এ জন্য আমরা সবাইকে আহ্বান জানাবো, তাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং টেকসই প্রত্যাবাসনে একটি বাস্তব রোডম্যাপ যত দ্রুত সম্ভব তৈরি করুন। আর সময় নষ্ট না করে এখন কাজ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জীবন রক্ষাকারী কাজ চলমান রাখতে দাতাসংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অপিরিমিত অবদান এখানে প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সময়ে আমরা অংশীজনদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, ভবিষ্যতের জন্য পর্যাপ্ত ও টেকসই অর্থায়ন করার পদক্ষেপ নিতে।
তৃতীয়ত, রোহিঙ্গাদের প্রতি সব ধরনের নিপীড়ন এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। আমরা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এবং আরাকান আর্মির প্রতি আহ্বান জানাই রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং জীবিকা নিশ্চিত করার। আর কোনো রোহিঙ্গা যাতে বাংলাদেশে না আসে তা মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরতে দিতে হবে।
চতুর্থত, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সহিংসতা বন্ধে, জাতিগত নিপীড়ন রোধে পরামর্শ কিংবা সংলাপের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। আমরা মিয়ানমার সরকার এবং রাখাইন কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাই রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিতে, স্বেচ্ছায় নিরাপদ প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার।
পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা বিশেষ করে আসিয়ানকে রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। আপনাদের সবার সহযোগিতা এই সংকটের সমাপ্তি টানতে পারে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো সচল হওয়ার আহ্বান জানাই।
ষষ্ঠত, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অবশ্যই জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
সপ্তমত, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানাই ন্যায় বিচার, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এবং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।
সম্মেলনের প্রথম দিনে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল সরাসরি বিদেশি অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় করে নিজেদের অভিজ্ঞতা, নির্যাতনের বর্ণনা ও প্রত্যাবাসনের আকাক্সক্ষা তুলে ধরেন। এ সময় এক রোহিঙ্গা তরুণ বলেন, আমরা বাংলাদেশে আশ্রিত কিন্তু এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে আমাদের দেশ মিয়ানমারে। বিদেশি প্রতিনিধিরা এ অভিজ্ঞতাকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার আশ্বাস দেন।
জাতিসংঘের এক প্রতিনিধি সভায় বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যই এ সমস্যার সমাধান জরুরি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি জানান, তাদের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে, তবে সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়াতে হবে।
আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, তিন দিনের এই সম্মেলন থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যকর রূপরেখা প্রণয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফান্ড গঠন, গণহত্যার বিচার, খাদ্য ও মানবিক সহায়তা এবং রোহিঙ্গাদের মানসিক শক্তি ও মনোবল বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও জোর দেয়া হবে।
আজ মঙ্গলবার বিদেশি অতিথিরা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। সেখানে তারা সরাসরি বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে বর্তমান দুঃসহ জীবনের কথা শুনবেন।
অংশীজন সংলাপে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম (বীর প্রতীক), রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজু প্রমুখ।
সংলাপে বিভিন্ন দেশের কুটনীতিক, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছেন।