৩৭ হাজার কোটি টাকার ১০০ মামলা নিষ্পত্তির তাগিদ

আদালত ঋণখেলাপির সম্পত্তি দখলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু ওখানে বসে আছেন অবৈধ দখলদার। আদালত সমন জারি করেছেন, অথচ পুলিশ ধরছেন না আসামিদের। এদিকে এক রিট মামলা খারিজ হলে গ্রাহক অন্য আদালতে গিয়ে আরেক রিট করছেন। এমন উদাহরণও রয়েছে যে এক মামলার রায়ের বিপরীতে ৪৪টি রিট করা হয়েছে।
ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা মিলিয়ে ১১ প্রতিষ্ঠানের করা ১০০টি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে এসব পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। সচিবালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বিডিবিএল, বেসিক ব্যাংকসহ সাধারণ বীমা করপোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
সূত্রগুলো জানায়, ব্যাংকের পক্ষে ও বিরুদ্ধে সাধারণত রিট মামলা, অর্থঋণ মামলা, সার্টিফিকেট মামলা এবং দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা হয়ে থাকে। এর মধ্যে সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, যা সংখ্যায় ইতিমধ্যে দেড় লাখ ছাড়িয়েছে। যদিও এই সার্টিফিকেট মামলায় জড়িত টাকার পরিমাণই সবচেয়ে কম। বর্তমানে ১১ প্রতিষ্ঠানের ১০০ মামলার বিপরীতে ৩৭ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা জড়িত। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ও জরিমানা আদায়ের টাকা রয়েছে। আবার সংস্থাগুলোর কাছে কোনো কোনো গ্রাহকের পাওনা দাবির ঘটনাও রয়েছে।
গতকালের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিষয়গুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, জেলা প্রশাসক ও সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের সহযোগিতা চাইবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এতে আরও বলা হয়েছে, এই ১০০ মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ফোকাল পয়েন্ট ঠিক করবে এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা মাসে একবার বৈঠক করে হালনাগাদ চিত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানাবে।
নামজারি ও সম্পত্তি দখলের জন্য জেলা প্রশাসকের আদালতে মামলা করার বিধান আছে, এই আলোচনা বৈঠকে উত্থাপিত হলে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে তারা ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকের আদালতে বেশ কিছু মামলা করেছে।
জানা গেছে, যে ঘটনায় ৪৪টি রিট মামলা হয়েছিল, তার মধ্যে ৪৩টিই খারিজ হয়ে গেছে, বাকি আছে ১টি। বৈঠক থেকে বিএসইসিসহ সব প্রতিষ্ঠানকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে, সবাই যেন গ্রাহকের সঠিক ঠিকানায় চিঠি পাঠান, পরে যাতে কেউ বলতে না পারেন যে তাঁরা চিঠি পাননি।
সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকে আলোচনা হয়েছে যে মামলাগুলো শুনানির তালিকায় থাকে ঠিকই, তবে নম্বর তালিকার অনেক নিচের দিকে। ফলে শুনানি হতে সময় লাগে বেশি। আবার অর্থঋণ আদালত কোনো মামলার রায় দিলে দেনাদার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ওই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করার আবেদন জানিয়ে রিট করে। চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত উচ্চ আদালতে যেতে না পারার বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। এক মামলার রায়ের বিপরীতেই হচ্ছে একাধিক রিট।
গতকালের বৈঠক শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করলাম। প্রতিষ্ঠানগুলো মনোযোগ আরেকটু বাড়ালে মামলাগুলো দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি হবে। সবাইকে বলা হয়েছে, শুনানির দিন শুধু প্যানেল আইনজীবী থাকলেই চলবে না, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লোকও যেন উপস্থিত থাকেন।’
কোন সংস্থার কত টাকা
১০০ মামলার বিপরীতে মোট টাকার পরিমাণ হচ্ছে ৩৭ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের একারই ১০ মামলার বিপরীতে ১৫ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। বৈঠকে অংশ নেওয়া জনতা ব্যাংকের এমডি মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছু নির্দেশনা পেয়েছি। সে অনুযায়ী এখন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ৫ হাজার ৬৭৬ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৮০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৩ হাজার ৭৪৮ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৪০০ কোটি এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) ১ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা জড়িত। প্রতিটির ১০টি মামলার বিপরীতে জড়িত এসব টাকা।
এদিকে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসির (বিডিবিএল) ১০টি মামলায় ৮৭৬ কোটি, আইসিবির ৮ মামলায় ৮৬০ কোটি, রাকাবের ১০ মামলায় ২৯৪ কোটি এবং বিএসইসির ২ মামলায় ৮৪ কোটি টাকা জড়িত রয়েছে। সাধারণ বীমা করপোরেশনের নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তালিকায় ৩ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা জড়িত বলে দেখানো হয়েছে।
যোগাযোগ করলে সাধারণ বীমা করপোরেশনের এমডি হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকৃত হিসাব করলে আমাদের সঙ্গে জড়িত অঙ্ক খুবই সামান্য হবে। অন্য এক ব্যাংকের কাছে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য এক গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মানহানির মামলা করেছে। সেই মামলার ১১ নম্বর আসামি আমরা।’