আন্দোলন দমনে হাসিনার নির্দেশে লেথাল উইপন ব্যবহার করা হয়

জুলাই আন্দোলন দমনে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও মারণঘাতী লেথাল উইপন ব্যবহারের নির্দেশনাটি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার নির্দেশেই মারণঘাতী এসব অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছিলো। জুলাই আন্দোলনটি বৈধ আন্দোলন ছিল। এই আন্দোলনে সংঘটিত অপরাধের আমিও অংশীদার। সে সময়ে আমার দায়িত্বে অবহেলা ছিল। আমি এজন্য দোষ স্বীকার করে ‘গিল্টি প্লিড’ করেছি। এছাড়া র্যাব’র মহাপরিচালক থাকাকালে ‘টিএফআই’ সেলে বন্দি ব্যারিস্টার আরমানের বিষয়টি আইনিভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম বলে ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীর জেরায় এসব কথা বলেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার জেরায় এমন দাবি করেছেন আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি মামুন। গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের দায় স্বীকার করে মঙ্গলবার ৩৬তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন সাবেক এই আইজিপি। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জেরা শুরু করেন মামলার পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। একদফা বিরতি দিয়ে বিকাল সোয়া ৪টায় শেষ হয় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর জেরা। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৮ই ও ৯ই সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
টিএফআই সেলে থাকা ব্যারিস্টার আরমানকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলাম: স্টেট ডিফেন্সের প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই পুলিশ প্রধান দাবি করেন তাকে চেষ্টা করেও টিএফআই সেল থেকে মুক্ত করতে পারিনি। আমি তার বিষয়টি আইনি সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম।
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি করা বৈধ নয়: সাক্ষীর জেরার একপর্যায়ে তিনি বলেন, সরকার কর্তৃক আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেয়া বৈধ। তবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের গুলি করা বৈধ নয়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রতি রাতে কোর কমিটির বৈঠক হতো। এই বৈঠকের প্রথম দিকে গুলির নির্দেশনা আসে নাই। গত বছরের ১৮ই জুলাইয়ের পরবর্তী বৈঠক থেকে গুলির এসব নির্দেশনা আসে। লেথাল উইপন ব্যবহারের নিদের্শনা আসে। লেথাল উইপন বলতে কোন সব অস্ত্র বুঝিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব অগ্নায়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয় সেসব অস্ত্রকে বুঝিয়েছি। তিনি বলেন, পুলিশ সাধারণত রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, পিস্তল, রিভলবার, শর্টগান, গ্যাসগান, সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে।
তিনি বলেন, পুলিশ আপরাধ দমনে আনুপাতিক হারে বল প্রয়োগ করে। যখন পুলিশ আক্রান্ত হয়, তখন যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে ঠিক সেভাবেই পুলিশ প্রতিরোধ করে।
আইজি থাকাবস্থায় পুলিশের নতুন অস্ত্র হিসেবে ‘স্নাইপার’ সংযুক্ত হয়েছিল: তিনি বলেন, পুলিশের আইজি থাকা অবস্থায় ‘স্নাইপার’ নতুন অস্ত্র হিসেবে সংযোজন করা হয়েছিল। পুলিশের বিশেষায়িত টিম ‘সোয়াত’-এ স্নাইপারটি অস্ত্র হিসেবে সংযোজন করা হয়েছিলো। এই অস্ত্র ব্যবহারে আমেরিকা সোয়াত’কে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো। তবে আন্দোলন দমনে পুলিশ স্নাইপার ব্যবহার করেছিল কিনা সেটি আমার জানা নেই।
সাক্ষীর জেরার এই পর্যায়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, আপনি ৫ই আগস্টের পরে সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আপনি কি তখন টিভি বা অন্য কোনো মিডিয়ায় এই সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার আন্দোলনে স্নাইপারের গুলির কথাটি শুনেছেন। জবাবে মামুন বলেন, আমি সেনানিবাসে টিভি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই কথাটি শুনি নাই।
ডিসি ইকবালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছিলাম: তিনি বলেন, গত বছরের ২৭শে জুলাই আন্দোলনের সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে তারা নারায়ণগঞ্জে যায়। এদিন যাত্রাবাড়ী থানার সামনে তারা যাত্রা বিরতি করে। পুলিশের গুলির বিষয়টি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে জানাচ্ছেন ডিসি ইকবাল। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিটি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশে পুলিশ গুলি করেছে তবুও ডিসি ইকবালের বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম।
অনেক কিছুর ক্ষমা হয়, তবে হত্যা মামলার ক্ষমা হয় না: শেখ হাসিনার আইনজীবী: এদিকে জেরার বিরতির সময় এক প্রতিক্রিয়ায় আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল কোনো অপরাধ করেননি, তারা কোনো নির্দেশও দেননি। তিনি বলেন, আজকে আমি তাকে জেরা করেছি। জেরার একপর্যায়ে সাবেক আইজিপি ক্ষমা চেয়েছেন। তবে ক্ষমা চাইলেই সবকিছুর ক্ষমা হয় না বলে আমি জানিয়েছি। অনেক কিছুর ক্ষমা হয়। কিন্তু হত্যা মামলার কোনো ক্ষমা হয় না।