সব কৌশল ব্যর্থ, গলার কাঁটা লুটের ১৩৫৩ অস্ত্র

একের পর এক উদ্যোগ। পুলিশের অভিযান। বিশেষ অভিযান। যৌথ বাহিনীর অভিযান। অপারেশন ডেভিল হান্ট। লক্ষ্য অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পাশপাশি লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে সব কৌশল। কিছুদিন আগে লুটের অস্ত্র উদ্ধারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাতেও মিলছে না সাড়া। লুটের এসব অস্ত্র উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারি এসব অস্ত্র উদ্ধার না হওয়াটা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এসব অস্ত্র লুটের পর হাত বদল হয়ে অপরাধীদের কাছে চলে গেছে। কার কাছে কীভাবে এসব অস্ত্র আছে এবং সেগুলো কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে সেই তথ্যও নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ইতিমধ্যে খুনখারাবি থেকে শুরু করে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে।
কিছু অভিযানে অপরাধীদের কাছে লুটের অস্ত্র মিলেছে। লুটের অস্ত্র কেনাবেচায় পুলিশেরও সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। উদ্ধার না হওয়া ১৩৫৩টি অস্ত্র এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন- জাতীয় নির্বাচনের আগে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এসব অস্ত্র নির্বাচনে ব্যবহার হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ ছোট বড় অপরাধী থেকে শুরু করে এসব অস্ত্র এখন অনেক রাজনীতিবিদদের কাছে আছে। লুট হওয়া অস্ত্র ১ বছরের বেশি সময় ধরে উদ্ধার না হওয়া ও সব কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, গত বছর ৫ই আগস্টের পর দেশের ৬৬৪টি থানার মধ্যে ৪৬০ থানা ও ১১৪টি ফাঁড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণভবন থেকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুট হয়। এ ছাড়া ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৩২টি গোলা-বারুদ নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪ হাজার ৪১০টি। এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৩৫৩টি। এছাড়া গোলা-বারুদের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪৯টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৯টি। পুলিশ জানায়, লুট হওয়া ১ হাজার ১০৬টি চায়না রাইফেলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৯৯১টি। আরেকটি মডেলের ১২টি রাইফেলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার হলেও একটি উদ্ধার হয়নি। এসএমজি-(টি-৫৬) ২৫১টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২২১টি। এলএমজি (টি-৫৬) ৩৪টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩১টি। পিস্তল (টি-৫৪) ৫৩৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩২৫টি। ৯ ইনটু ১৯ মিমি ১ হাজার ৯২টি পিস্তলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৬৩০টি। ৯ ইনটু ১৯ এসএমজি/এসএমটি ৩৩টির মধ্যে সবকটি উদ্ধার হয়েছে। ১২ বোরের শটগান ২ হাজার ৭৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১৬৭৫টি। ৩৮ মিমি গ্যাসগান ৫৮৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৪৫৮টি। ৩৮ মিমি টিয়ারগ্যাস লাঞ্চার ১৫টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৮টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ৭টি। ২৬ মিমি পিস্তল ৩টির মধ্যে একটি উদ্ধার হয়েছে। গোলাবারুদের মধ্যে বিভিন্ন বোরের ৬ লাখ ১২ হাজার ৯৮২টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১১২টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭২০টি। বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস শেলের ৩১ হাজার ২১২টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১৯ হাজার ৮২১টি, বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস গ্রেনেড ১ হাজার ৪৮৬টির মধ্যে ১ হাজার ১৯৫টি, সাউন্ড গ্রেনেড ৪ হাজার ৭৪৬টির মধ্যে ৩ হাজার ৫৭৪টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ২৭৩টির মধ্যে ২৩২টি, সেভেন মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৫৫টির মধ্যে ৩৩টি, ফ্ল্যাশ ব্যাং/৬ গ্রেনেড ৯০০টির মধ্যে ৬১৬টি ও হ্যান্ড হেল্ড টিয়ারগ্যাস স্প্রে ১৭৮টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৬২টি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, হাত বদল হয়ে পুলিশের লুট হওয়া এসব অস্ত্র আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, দাগি আসামি, চরমপন্থি, স্থানীয় সন্ত্রাসী, জেল পলাতক আসামি, পেশাদার অপরাধী এমনকি রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হাতে চলে গেছে। লুট হওয়ার পর বিভিন্ন সময় এসব অস্ত্র ব্যবহার করে খুন-খারাবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে। তাই যতদিন এসব অস্ত্র পুরোপুরি উদ্ধার সম্ভব হবে না ততদিন নিরাপত্তা শঙ্কা থেকেই যাবে। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত গতানুগতিক কৌশল পাল্টে ভিন্ন কৌশলে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে বিভিন্ন অপরাধে বন্দি থাকা অপরাধীদের পাশাপাশি বহুল আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও জামিনে মুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, ফ্রিডম সোহেল, আরমান, হাবিবুর রহমান তাজ, নাজমুল মাকসুদ মুরাদসহ অনেকেই রয়েছেন। মুক্ত হয়ে তারা দেশে-বিদেশে অবস্থান করে ফের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা আবার সন্ত্রাসী দল গঠন করেছেন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোতাহের হোসেন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, গত বছরের ৫ই আগস্ট জেল ভাঙার ঘটনায় ২ হাজার ২০০ বন্দি পালিয়ে যায়, যার মধ্যে এখনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তসহ ৭০০ জন পলাতক রয়েছে। এদের মধ্যে ৬৯ জন জঙ্গি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া লুট হওয়া ২৯টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের ধারণা, জেল পলাতক এসব আসামি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়েছেন। তারাও লুট হওয়া অস্ত্র কিনে নিয়েছেন।
প্রকাশ্যে গোলাগুলি: চলতি বছরের ২৫শে মে রাত ১১টায় রাজধানীর বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন গুলশান থানা বিএনপি‘র যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধন। এ সময় দুই তরুণ তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। এর দুদিন পর ২৭শে মে মিরপুরে গুলি করে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর ২১ লাখ টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। ৬ই আগস্ট মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে গুলিতে মারা যান শাহেন শাহ নামে এক তরুণ। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে। গত ২০শে আগস্ট দাবি করা ৫০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে এক ব্যবসায়ীর বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে একদল অস্ত্রধারী যুবক। বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজে হামলার বিষয়টি ধরা পড়ে। এসব ঘটনায় কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে তা নিশ্চিত না হলেও লুট হওয়া অস্ত্র ব্যবহারের শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা।
লুটের অস্ত্র অপরাধে: গত বছরের ৩০শে নভেম্বর মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস লেন থেকে শাহিদা আক্তার (২২) নামের এক তরুণীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় শাহিদার কথিত বন্ধু তৌহিদ শেখ ওরফে তন্ময় গ্রেপ্তার হন। পরে পুলিশ জানায়, ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট করা পিস্তল দিয়ে শাহিদাকে গুলি করে হত্যা করেন তৌহিদ। তার তথ্যের ভিত্তিতে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। গত ৪ঠা এপ্রিল খুলনা মহানগরে অভিযান চালিয়ে ফারুক হোসেন (২৩) ও খাইরুল সরদার (২৭) নামের দুই যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, একটি শটগান ও শটগানের সাতটি গুলি উদ্ধার করার কথা পুলিশ জানায়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, উদ্ধার করা শটগান ও গুলির গায়ে লেখা ছিল ‘বিডি পুলিশ’। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক স্বীকার করেন, তিনি বিভিন্ন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দুষ্কৃতকারীদের কাছে অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা করে আসছিলেন। চট্টগ্রামে গত মে মাসে মো. পারভেজ ও রিয়াজুর রহমান নামের দুজন গ্রেপ্তার হন। তাদের কাছ থেকে নগরের পাহাড়তলী থানা থেকে লুট হওয়া রিভলবার ও গুলি উদ্ধার করা হয়। তারা এই অস্ত্র দিয়ে ছিনতাই-লুটপাট করতেন বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান। চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গুলিসহ আরিফ হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় গত ১৭ই এপ্রিল। সে সময় পুলিশ বলে, লুটের অস্ত্র-গুলি ব্যবহার করে নগরের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি করতেন আরিফ।
২৫শে আগস্ট লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারে পুরস্কারের ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, লুট হওয়া বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গুলির সন্ধানদাতাদের পুরস্কৃত করা হবে এবং তথ্যদাতাদের পরিচয়ও গোপন রাখা হবে। পিস্তল ও শটগানের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা, চায়না রাইফেলের ক্ষেত্রে এক লক্ষ টাকা, এসএমজি’র ক্ষেত্রে এক লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ও এলএমজি’র ক্ষেত্রে পাঁচ লক্ষ টাকা হারে পুরস্কার দেয়া হবে। তাছাড়া প্রতি রাউন্ড গুলির ক্ষেত্রে ৫ শত টাকা হারে পুরস্কৃত করা হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন, লুট হওয়া অস্ত্রের বড় অংশই উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এখনো কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে আরও জোড়ালো অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করা হবে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, লুট হওয়া যেসব অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, সেগুলো সমাজের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য হুমকি। সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে এ অস্ত্রগুলো নির্বাচনে ব্যবহার হওয়ার অনেক আশংকা রয়েছে। এ ছাড়া আমরা দেখতে পেয়েছি যে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখল বাণিজ্যের হাতবদল হয়েছে। এ অস্ত্রগুলো এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুলিশকে দ্রুতই চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে, না হলে সমাজের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র নিয়ে মারাত্মক শঙ্কা রয়েছে। কারণ অপরাধীরা জানে এটা দিয়ে কোনো অপরাধ করলেও তাদের ধরা যাবে না এবং দায়বদ্ধ করা যাবে না।