Bangladesh

ডলারের দর নিয়ে উভয় সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

কয়েক মাস ধরে কমছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ডলার সংকট না কাটার পেছনে এটাও অন্যতম কারণ। এ পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স বাড়াতে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে না রেখে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন অনেকে। সফররত আইএমএফ মিশনও এমন সুপারিশ করেছে। আবার অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ চাইছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, একদিকে রেমিট্যান্স বাড়ানোর তাগিদ যেমন রয়েছে, তেমনি ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করলে আমদানিপণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতি আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন বাস্তবতায় ডলারের দর নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের অনেকেই বলছেন, বাজারভিত্তিক করলেই সংকট কেটে যাবে, তা নয়। এ জন্য সবার আগে অর্থ পাচার ও হুন্ডি চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যাংকের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। কেননা আন্তর্জাতিকভাবে ডলারের সুদহার এখন ৯ শতাংশের মতো। এর সঙ্গে বিনিময়হারজনিত লোকসান হিসাব করলে অনেক ক্ষেত্রে তা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হয়। এ কারণে বেসরকারি খাত এখন বিদেশি উৎস থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো ডলার কিনে আগে নেওয়া বিদেশি ঋণ পরিশোধ করছে। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরও সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে বড় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে আসল জায়গায় হাত না দিয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ডলারের দর বাজারের ওপর ছাড়লে দর যতই বাড়ুক, এর চেয়ে ৬ থেকে ৭ টাকা বেশি থাকবে হুন্ডিতে। হুন্ডির চাহিদা প্রধানত আসে যারা দেশ থেকে পুঁজি পাচার করে তাদের দিক থেকে। বিশেষ করে ঋণের টাকার অপব্যবহার, কর ফাঁকি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা পাচার হয়। এদের কাছে ডলারের দরের চেয়ে সম্পদ বাইরে নিয়ে নিরাপদ করা মুখ্য বিষয়। পুঁজি পাচারকারীদের দমন না করলে ডলারের দর স্থিতিশীল হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকদিন ধরে ডলারের দর ৮৪ থেকে ৮৬ টাকায় ধরে রেখেছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তা আর ঠেকানো যায়নি। গত দু’বছরে প্রতি ডলারে ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে। দর নিয়ন্ত্রণে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলার কেনা ও বিক্রির একটি দর ঠিক করে আসছে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা। প্রথমে রপ্তানিতে ৯৯ টাকা এবং রেমিট্যান্সে ১০৮ টাকা দর বেঁধে দেওয়া হয়। এখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ১১০ টাকা এবং আমদানিতে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। তবে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে এ দরে সাধারণত ডলার পাওয়া যায় না। যে কারণে অনেক ব্যাংক বাড়তি দর দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এখনকার সংকট কাটানোর প্রধান উপায় ডলারের জোগান বাড়ানো। তবে ডলারের দর এভাবে বেঁধে দিয়ে তা সম্ভব নয়। প্রতি মাসে একটু একটু করে দর বাড়ানোর অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। প্রয়োজনে দর একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে একটা নিম্ন ও ঊর্ধ্বসীমা আরোপ করা য়ায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়তো বলে দিল, ১১৫ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে থাকতে হবে। তখন এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে ব্যাংকের দর কষাকষির একটা জায়গায় থাকবে।

ব্যাংকাররা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বাজার ঠিক করতে আসল সমস্যা সমাধানে নজর না দিয়ে শুধু ব্যাংকের ওপর দায় চাপিয়ে আসছে। হুন্ডিকারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকের বিরুদ্ধে একের পর এক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চাপিয়ে দেওয়া দরে ডলার না পাওয়ায় সম্প্রতি ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। গত বছর ১২টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। হুন্ডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু ব্যাংকের ওপর চাপাচাপির কারণে হুন্ডি উৎসাহিত হয়েছে। এখন প্রতি মাসে একটু করে বাড়ানোর ফলে একটা মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা তৈরি হয়েছে যে, দর আরও বাড়বে। প্রবাসীদের অনেকেই ভাবছেন, ব্যাংক যে দরই দিক তারা হয়তো ঠকছেন। ফলে আগে কখনও অবৈধ উপায়ে ডলার পাঠাত না, এরকম একটি অংশ এখন হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছে। যে কারণে রেকর্ড শ্রমিক বাইরে গেলেও রেমিট্যান্স কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ অক্টোবরের প্রথম ১৩ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে ৭৮ কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরে আসা ১৩৪ কোটি ডলার ছিল ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্স ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমে ৪৯২ কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ এখন কম আসছে। অথচ আগে নেওয়া ঋণ পরিশোধের বড় চাপ রয়েছে। এসব কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরও রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। চলতি বছরের এ সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এতে করে আইএমএফের পদ্ধতি অনুযায়ী নিট রিজার্ভ কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে যে নিয়মে হিসাব করত, সে অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ২৬ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিশেষ করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেশের বাইরে পাচার ঠেকানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্নীতি বা কর ফাঁকি দিতে যারা পুঁজি পাচার করছে, তারা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে নিতে হবে ব্যবস্থা। এছাড়া শুধু বাড়তি শুল্ক আরোপ বা শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ না করে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি প্রয়োজনে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। ব্যাংক এশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী সমকালকে বলেন, দুই বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দর ৩০ শতাংশ বেড়েছে। সাধারণভাবে কোনো পণ্যের দর বাড়লে চাহিদা কমে। তবে ডলার ও শেয়ারের দর বাড়লে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন দর অনেক বেড়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের বাস্তবতায় একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দর নিয়ন্ত্রণ করা খারাপ নয়। একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে তখন ট্রেডাররা সুবিধা নেয়। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক থাকলে তখন ডলারের দর পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়। আমাদের রিজার্ভ এখন নিম্নমুখী। এখন বাজারভিত্তিক করলে বরং সংকট আরও বাড়বে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d online