অধিগ্রহণের আনুষঙ্গিক অর্থ ব্যয়ের নীতিমালা নেই: পড়ে আছে ৫শ কোটি টাকা, ২৪ ডিসি অফিসের এলএ শাখার হিসাব
অর্থ ব্যয়ের নীতিমালার অভাবে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ‘আনুষঙ্গিক খাতের’ পৌনে ৫০০ কোটি টাকার বেশি অলস অবস্থায় পড়ে আছে। দীর্ঘ ৪৩ বছর (১৯৭৭-২০২০) দেশের ২৪টি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখার হিসাবে বিপুল অঙ্কের এই অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। সরকারি এক প্রতিবেদনে (সিএজি) অলস পড়ে থাকার তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি বছর পর্যন্ত সব ডিসি অফিসের এলএ শাখার হিসাব যোগ করলে এর অঙ্ক দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এই অর্থের ব্যয় ও উত্তোলন কোনোটাই সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে অধিগ্রহণের আনুষঙ্গিক অর্থ ব্যয়ের নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৮ সালে। একটি খসড়াও তৈরি করে ভূমি মন্ত্রণালয়। কিন্তু অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে নানা অযৌক্তিকতা চিহ্নিত করে আপত্তি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ভূমি এবং অর্থ এই দুই মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন মতামতের কারণে প্রায় ১৫ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি নীতিমালাটি। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য।
প্রসঙ্গত, সরকারি প্রতিষ্ঠান ভূমি অধিগ্রহণ করলে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে আনুষঙ্গিক খাতে খরচ হিসাবে ২ শতাংশ হারে টাকা কেটে রাখা হয়। এটি এক ধরনের সরকারের পরোক্ষ আয়। এ টাকা ব্যয় করার কথা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখার। এ অর্থ দিয়ে অধিগ্রহণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কম্পিউটার ক্রয়, প্রিন্টার, প্রিন্টারের কালি, ইন্টারনেটের যন্ত্রাংশ ক্রয়, ফটোস্ট্যাট মেশিন, ভিডিও ক্যামেরা, ক্যামেরা, স্ক্যানার কেনার কথা। এছাড়া সার্ভে যন্ত্রপাতি, ডিজিটাল সার্ভে মেশিন ক্রয়, কেনা যন্ত্রপাতি ও যানবাহন মেরামতসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় হওয়ার কথা। কিন্তু কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হবে, কীভাবে ব্যয় হবে এর কোনো নীতিমালা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের পরও সেটি ব্যয় করতে পারছে না সরকার। কিন্তু এ ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য এলএ শাখা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মূল বাজেট থেকে ব্যয় করেছে। ফলে সরকারের ২ শতাংশ হারে আদায়ের অর্থ ব্যয় না হওয়ায় দিন দিন অলস অর্থের পরিমাণ বেড়েই চলছে।
সরকার কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মন্দা ধাক্কা মোকাবিলায় ২০২০ সাল থেকে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ সাধন করছে। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগে বরাদ্দের পর অব্যয়িত বা উদ্বৃত্ত অর্থ ফেরত আনারও বিধান প্রণয়ন করেছে। ব্যয়ের কৃচ্ছ সাধনসহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হলেও নীতিমালার অভাবে বছরের পর বছর পড়ে আছে ৫০০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জেলা প্রশাসক (ডিসি) বলেন, অলসভাবে রাষ্ট্রের অর্থ যুগের পর যুগ ফেলে রাখা মোটেও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। সেটি জানা সত্ত্বেও আমাদের (ডিসি) পর্যায়ে এ নিয়ে কথা বলতে পারছি না। এই অর্থ সরকার কোষাগারে নিলে বাজেটের মাধ্যমে ভিন্ন খাতে ব্যয় করতে পারবে।
এ বিষয়ে ভূমি সচিব মো. খলিলুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমরা সহসাই একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছি। সম্প্রতি এ নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। বিভিন্ন জেলার ডিসিরা এ বিষয়ে আমাকে অবহিত করেছেন। আশা করছি শিগগিরই সমাধান হবে। অলসভাবে পড়ে থাকা অর্থ রাষ্ট্র অন্য কোনো খাতে বা সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যবহার করতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, সেটি এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি দেখে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৭৭-২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের ২৪ জেলায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ৪৭৫টি ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের সঙ্গে অধিগ্রহণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আনুষঙ্গিক খাতে ৪৮৬ কোটি ৩১ লাখ ৬১ হাজার ২৪৬ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে টাঙ্গাইল ডিসি কার্যালয়ে প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা, গাজীপুর ডিসি কার্যালয়ে ৮৭ কোটি টাকা আছে। একইভাবে দেখা গেছে, ১৯৮৬-২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩১ বছর ধরে ময়মনসিংহ ডিসি অফিসে প্রায় ৯ কোটি টাকা পড়ে আছে। এছাড়া গত ৩৮ বছর (১৯৮১-২০১৯) পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ ডিসি অফিসে পড়ে আছে প্রায় ২৩ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই সময়ে জামালপুর ডিসি কার্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে ২২ কোটি টাকা, বগুড়ায় ৩২ কোটি টাকা, খাগড়াছড়িতে ২ কোটি টাকা, খুলনায় ৪৯ কোটি টাকা ও বরিশালে ৬ কোটি টাকা পড়ে আছে। আরও রয়েছে ঝিনাইদহে ১ কোটি টাকা, গোপালগঞ্জে ১৬ কোটি টাকা, মাদারীপুরে ৫৩ কোটি টাকা, শরীয়তপুরে ৪ কোটি টাকা, নরসিংদীতে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। এছাড়া কুমিল্লায় ২৮ কোটি টাকা, রংপুরে ১০ কোটি টাকা, গাইবান্ধায় ৮ কোটি টাকা রাজশাহীতে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা, মানিকগঞ্জে প্রায় ৮ কোটি টাকা, সিলেটে ২০ কোটি টাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় ২৬ কোটি টাকা, সুনামগঞ্জে ৪ কোটি টাকা ও নেত্রকোনায় প্রায় ১২ কোটি টাকা।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফিন সোমবার বলেন, নীতিমালা না থাকায় জমি অধিগ্রহণের আনুষঙ্গিক বরাদ্দ ব্যয় করা যাচ্ছে না। আগে মৌখিক নির্দেশে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করা গেলেও সেটি পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, টাঙ্গাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর অধীনে এলএ মামলায় (০৬-২০১৭-২০১৮) ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা অলসভাবে পড়ে আছে। একই এলাকায় এলএ মামলার (১০/২০১৮-১৯) ঘটনায় প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা পড়ে আছে। সাসেক সড়ক প্রকল্পের আওতায় এ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এদিকে গাজীপুরে ঢাকা বাইপাস সড়ক প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের আওতায় ১ কোটি ২২ লাখ টাকা আনুষঙ্গিক খাতের বরাদ্দ পড়ে আছে। একইভাবে দেখা গেছে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শীর্ষক প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের আনুষঙ্গিক বরাদ্দ ১ কোটি ১০ লাখ টাকা পড়ে আছে।