ঝুঁকিতে চার কোটির জীবিকা
![](https://miprobashi.com/wp-content/uploads/2023/11/043ed44d089dcf5bb312ef8ee78bd221-65494d88a931d.webp)
ডলার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে দেশে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। রিজার্ভও তলানিতে। ঋণপত্র খুলতে না পারায় গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন চলছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচির কারণে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ দুই-ই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে দেশের চার কোটি পেশাজীবীর ওপর। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অনেক পেশাজীবীর দৈনন্দিন আয় বন্ধ বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসারে পেশাজীবীদের তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সেপ্টেম্বর শেষে দেশে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত জনগোষ্ঠী ৭ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে শুধু কৃষিতে নিয়োজিত আছে ৩ কোটি ১২ লাখ জনগোষ্ঠী। আর শিল্পে নিয়োজিত ১ কোটি ২১ লাখ ও সেবা খাতে ২ কোটি ৭৭ লাখ মানুষ কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। স্বনির্ভর পেশা হওয়ায় কৃষিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীকে বাদ দিলে শিল্প ও সেবা খাতে কর্মে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় চার কোটি জনগোষ্ঠী। দেশের দৈনিক শ্রমজীবী মানুষও সেবা খাতের অংশ। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিল্প ও সেবা খাতের এসব পেশাজীবীর নিয়মিত আয় হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে পরিবহন, দোকানকর্মী ও খেটে-খাওয়া মানুষের আয় আছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে এসব পেশার মানুষদের দৈনন্দিন আয় থমকে থাকে। এ ছাড়া যেসব পেশাজীবীর আয় প্রতিষ্ঠাননির্ভর, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় তারাও থাকেন শঙ্কায়।রাজনীতির এ চলমান আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে পরিবহন খাত। যাত্রী পরিবহন কিংবা পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে বড় ভূমিকা এ খাতের। কিন্তু হরতাল অবরোধে পরিবহন বন্ধ রাখলে এর সঙ্গে যুক্ত চালক ও চালকের সহযোগীদের দৈনিক আয় বন্ধ থাকে। এ ছাড়া পণ্য সরবরাহও বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কাই বেশি। পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহন করা না গেলে পণ্য ও পরিবহন সেক্টরের সংশ্লিষ্টদের আয় থেমে যায়।
এ ছাড়া খুচরা ব্যবসায়ীরাও সংকটের মধ্যে রয়েছে। আন্দোলনের কারণে অনেকেই দোকান খুলতে পারছেন না। যারা দোকান খুলেছেন তারা আবার পর্যাপ্ত ক্রেতাও খুঁজে পাচ্ছেন না। দিনের পর দিন দোকান বন্ধ রাখলেও দোকান ভাড়া দিতে হয়। তাছাড়া দোকানের পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেটা তার মাসিক আয়ে প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে ফুটপাতে ব্যবসায়ীরা হরতাল অবরোধে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন না। এতে তার আয় বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু পরিবহন বা খুচরা ব্যবসায়ীরা নন, হরতাল অবরোধে দেশের নানান ছোট ছোট পেশায় নিয়োজিত মানুষের রোজগারও বন্ধ থাকে। যারা বেশিরভাগই দৈনিক আয়ে জীবনযাপন করেন।
এদিকে অক্টোবরের শেষদিকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে যোগ হয়েছে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন। পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে দেশের এ প্রধান রপ্তানি খাতে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কারখানার মালিকরা। গত অক্টোবরে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। স্বাভাবিকভাবে যখন উৎপাদন কমে যায়, কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে। অনেক কোম্পানি লোকসানেও পড়ে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোম্পানিগুলো ব্যয় সংকোচন নীতিমালা হাতে নেয়। এতে কর্মী ছাঁটাই হয়, অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় বেতন বকেয়া হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা গত মাস থেকে শুরু হলেও দেশের অর্থনীতিতে দৈন্যদশা শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরপরই। ডলার সংকটের জেরে আমদানিনির্ভর সব পণ্যেই দাম আকাশছোঁয়া। ডলার, কাঁচামাল ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেক কোম্পানি ইতিমধ্যেই লোকসানে পড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে উন্নত দেশগুলোতে চাহিদা কমায় দেশের রপ্তানিনির্ভর খাতগুলোতেও অস্থিরতা রয়েছে।
কয়েকটি খাতে কর্মসংস্থান যে হুমকির মুখে পড়েছে, তা বিবিএসের জুনে প্রকাশিত শিল্প উৎপাদন সূচকের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হওয়া যায়। মধ্য ও মাঝারিমানের শিল্পের মধ্যে রাইস মিলগুলোর উৎপাদন কমেছে গত বছরের তুলনায় ২৪ শতাংশের বেশি, চামড়া শিল্পের উৎপাদন কমেছে ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ফুটওয়্যারের উৎপাদন কমেছে ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।
জুনের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই- সেপ্টেম্বর) শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ২২ শতাংশের বেশি। কয়লা, ক্লিংকারসহ অন্যান্য মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৪ শতাংশ। আমদানির এ চিত্রই বলে দিচ্ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কেমন যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংস আন্দোলন শিল্পের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। কাঁচামাল ও প্রস্তুত পণ্যের সরবরাহে বাধা তৈরির পাশাপাশি কারখানা সচল রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ গ্রহণকারী কোম্পানিগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। ঋণ পরিশোধেই কোম্পানির আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ চলে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটি ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে ঋণপত্র খোলার হার গত বছরের তুলনায় কমেছে ১৮ শতাংশ। ঋণপত্র খুলতে না পারলে আমদানিনির্ভর এ দেশে বিনিয়োগ কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর বিনিয়োগ কমলে প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানেও।
তবে কৃষকরা যে এ অস্থিরতার বাইরে রয়েছেন তাও বলা যায় না। বিবিএসের গত জুন পর্যন্ত শিল্প সূচকে দেখা যায়, বছরের ব্যবধানে দেশে সারের উৎপাদন কমেছে ১৯ দশমিক ২২ শতাংশ। কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত সার ও বীজ না থাকলে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। তারাও কর্মসংস্থান হারিয়ে শহরমুখী হওয়ার চিন্তা করছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের রিজার্ভের পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমদানি কিছুটা সংকুচিত হয়েছে। এলসি খোলার হার কিছুটা কমেছে। সুতরাং এগুলোর নেতিবাচক অভিঘাত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ওপর পড়বে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর পড়বে। রপ্তানিমুখী ও আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্পের ওপর পড়বে।’
এ অর্থনীতিবিদের মতে, ‘রিজার্ভের ঝুঁকি, এলসি খোলায় নিরুৎসাহিত করার কারণে এসবের অভিঘাত কর্মসংস্থানের ওপর অবশ্যই পড়বে। আমাদের রিজার্ভ সুসংহত না করে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে যাতে সমস্যার সম্মুখীন না হন, এদিকে নজর দিতে হবে।’
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দেশের বিনিয়োগ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং ঘটমান সবকিছু নিয়ে অভিঘাতটা পড়বে বিনিয়োগের ওপর। এ জায়গায় অবশ্যই সরকারের নজর দিতে হবে যাতে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা ক্ষতির মুখে না পড়েন।’ চলমান শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া সংবেদনশীলভাবে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের যে দাবিদাওয়া তাতে সংবেদনশীলভাবে নজর দিতে হবে যাতে শিল্পে শৃঙ্খলা থাকে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির অনিশ্চয়তা কাটিয়ে কীভাবে আগের জায়গায় যেতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।’
বর্তমানে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ যদি কাজ হারিয়ে ফেলেন বা কর্মস্থলে আয় কমে যায়। ঘরে ফিরলেই চোখ রাঙাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। সর্বশেষ অক্টোবরে শুধু খাদ্য মূল্যস্ফীতিই ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। চলতি মাসে বাজার ব্যবস্থাপনা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবজির বাজার হতে শুরু করে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সব পণ্যই এখন লাগামছাড়া।
গত শনিবার তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সময় প্রয়োজন হবে। বেশ কিছু অর্ডারে সমস্যা হয়েছে, উৎপাদন হয়নি কয়েক দিন। অবস্থা ভালো নয়, সব মিলিয়ে বাজার পরিস্থিতিও হুমকির মুখে। এটি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।’
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে দেশে এবং দেশের বাইরেও একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়েও আমরা খুব চিন্তিত।’