Bangladesh

মৃত্যু ডেকে আনছে খাবারের বিষ

♦ প্রক্রিয়াজাত খাবারে অতিরিক্ত লবণ ♦ হোটেল-রেস্তোরাঁয় পচাবাসি খাবার ♦ খাবারের বিষে বাড়ছে ক্যান্সার কিডনি লিভার হার্টের রোগীর সংখ্যা ♦ চাল সবজি মাছ মাংস মসলা কোমল পানীয় সবকিছুতে ভেজাল

যে খাবার খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে সে খাবারের মধ্য দিয়েই প্রতিদিন শরীরে ঢুকছে বিষ। আর এটি ঘটছে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণে। মাটি ও পানি থেকে মাছ, মাংস, সবজি, ফলমূল হয়ে মানবদেহে প্রবেশ করছে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিকের মতো ধাতু। আবার একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী খাবারে ক্ষতিকর উপাদান মিশিয়ে বিক্রি করছেন। এতে দিন দিন শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজালযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে জটিল সব রোগবালাই নিয়ে আগের তুলনায় তাদের কাছে রোগী বেশি আসছেন। এর মধ্যে ক্যান্সার, হার্ট, লিভার ও কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগী। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে গর্ভবতী মায়েদের শিশুরাও। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাজারে বিক্রি হওয়া চাল, আটা, ডিম, মধু, সবজি, মাছ, মাংস, মসলা এবং খাবার পানি সবকিছুতেই আছে ভেজাল বা রাসায়নিক বিষ। আর এ বিষই ‘সেøা পয়জনিং’ হয়ে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অর্থাৎ খাবারের বিষ মৃত্যু ডেকে আনছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ২০২২ সালের আগস্টে ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টার্স’ জার্নালে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এ গবেষক দল জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলা থেকে মাটির ৬০টি ও বেগুনের ৮০টি নমুনা সংগ্রহ করে। এতে তারা আটটি ধাতুর পরিমাণ পর্যালোচনা করে দেখেন তাতে সিসা, নিকেল ও ক্যাডমিয়াম ধাতু নিরাপদ সীমার চেয়ে কয়েক শ গুণ বেশি বিদ্যমান। তারা জানান, অজৈব সার, কীটনাশক ব্যবহার ও সেচের পানিতে দ্রবীভূত ধাতুর উপস্থিতির কারণে এ এলাকায় উৎপাদিত বেগুনে ক্ষতিকারক ভারী ধাতুর উপস্থিতি আছে। আর এ ধরনের সবজি খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ছাড়া খামারে যে পশুপালন ও হ্যাচারিতে মাছের চাষ হয় সেখানে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয় নিয়মিত। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনকৃত পশুর মাংস খেলে শারীরিক স্থূলতা বৃদ্ধি পায়। আবার এসব পশু থেকেও সামান্য পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক মানবদেহে প্রবেশ করে। ফলে মানবদেহে ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশনের সময় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে তা আর কার্যকর হয় না। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানী ও এর বাইরের একটি শহরের ওপর চালানো গবেষণা সমীক্ষায় মাছ ও মুরগিতে ৮০ থেকে ৮৬ শতাংশ বিভিন্ন মাত্রার ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম ও সিসার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পরীক্ষায় ধাতু তিনটির মাত্রা শহরে বেশি এবং গ্রামে কম লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়া পরীক্ষায় মুরগি, ডিম ও চালে আর্সেনিক নামে প্রাণঘাতী বিষ পাওয়া গেছে। এতে মানবদেহে ক্যান্সার, কিডনিসহ ¯œায়বিক জটিলতা দেখা যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকের বর্জ্য প্রতিদিনই নদনদী ও জলাশয়ে গিয়ে পড়ছে। মাছ এসব খাচ্ছে আর মাছের মাধ্যমে তা মানবদেহে ফুড চেইনে ঢুকে পড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বাজারে পাওয়া ১৫ প্রজাতির দেশি মাছে ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার সন্ধান মিলছে। এসব মাছের মধ্যে আছে কালবাউশ, বেলে, টেংরা, কই, রুই, বাটা, পাবদা, পুঁটি, রয়না, শিলং, বাইন, টাটকিনি, বাছা, তেলাপিয়া ও কার্পজাতীয়। আবার বাজারে বিক্রি করা মাছে ব্যবহার হচ্ছে ফরমালিনও। দেশের বোতলজাত পানির ৫০ শতাংশই দূষিত। আবার অফিস-আদালত, বাসাবাড়িতে সরবরাহকৃত বড় বড় জারের পানির ৯৮ শতাংশই জীবাণুপূর্ণ। বাজারে শুকিয়ে যাওয়া শাক রাসায়নিকে ডুবিয়ে তাজা বলে বিক্রি করা হচ্ছে। আর কাঁচা ফল দ্রুত পাকাতে কার্বাইড, ইথোফেন ও ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পোলট্রি ফার্মের ডিমে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। আর আটায় মেশানো হচ্ছে চকপাউডার বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। আনারসে হরমোন দিয়ে দ্রুত বৃদ্ধির প্রক্রিয়া তো চলছেই। এর সঙ্গে আমগাছে মুকুল ধরা থেকে শুরু করে তা পাকা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে চলে রাসায়নিকের অবাধ ব্যবহার।

মিষ্টিজাতীয় খাবারেও ব্যবহার হচ্ছে বিষাক্ত রং, সোডা, স্যাকারিন ও মোম। আর খাবারের মসলায় কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হয়। এ ছাড়া ভেজাল মেশানো খাদ্যপণ্যের তালিকায় আছে ঘি, গুড়, মধু, শিশুদের গুঁড়া দুধ। বাজার থেকে সংগ্রহ করা ভেজাল গুঁড়া দুধ ও আটা মিশিয়ে বানানো হয় আরও ভেজাল দুধ। সেই দুধ আবার প্যাকেটজাত করা হয় নামকরা ব্র্যান্ডের মোড়কে। এভাবে ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার নাম দিয়ে বাজারজাত করা হয় ভেজাল গুঁড়া দুধ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে এবং দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ ১৫ লাখ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ পেটের রোগে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া ভেজাল খাদ্যের ফলে লিভার, কিডনি, হার্ট ও ক্যান্সারের মতো রোগেও মানুষ ভুগতে পারে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি থেকে বাচ্চার শারীরিক সমস্যা হতে পারে। ভেজালমুক্ত খাবার যাতে ক্রেতা খেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো খাবারের গুণগত মান ঠিক আছে কি না মাঝেমধ্যে নজরদারি করতে পারে। ভেজাল যারা খাচ্ছে তারা তো বটেই, যারা ভেজাল খাবার বিক্রি করছে তারাও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকে।’ এ-সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়নের ওপরও এই অধ্যাপক জোর দিয়েছেন।

সাধারণত বাজারে থাকা খাবারের প্যাকেটগুলোয় যে লেবেল থাকে সেখানে সঠিক তথ্য দেওয়া থাকে না। অনেক কোম্পানি খাদ্যপণ্যের সঠিক মাত্রার তথ্য গোপন করে বাজারজাত করে। এতে ভোক্তারা প্রতারিত হয়। বাজারে বিক্রি হওয়া প্রক্রিয়াজাত খাবারে রয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত লবণ। এতে কিডনি ও হার্টের ঝুঁকি বাড়ছে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটকৃত খাবারের লবণ নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব বলেন। ভেজালবিরোধী অভিযানে দেখা যায়, হোটেল-রেস্টুরেন্টে যে খাবার পরিবেশন করা হয় এর বেশির ভাগেরই উপাদান পুরনো এবং এতে নিম্নমানের তেল ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও দেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। এ আইনে ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধানও আছে। এ ছাড়া জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে ২০১৩ সালে। ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ভেজাল রোধে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এর পরও খাবারে ভেজাল কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button