কারা হচ্ছেন প্রার্থী আওয়ামী লীগ মনোনীতদের নাম ঘোষণা কাল
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পারদ এখন তুঙ্গে! শুধু প্রার্থীই নয়, সারাদেশের তিনশ’ আসনের আওয়ামী লীগের কোটি কোটি নেতাকর্মী, সমর্থকদের দৃষ্টিও এখন দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের দিকে। শেষ পর্যন্ত কারা হচ্ছেন নৌকার মাঝি, কাদেরইবা এবার কপাল পুড়লÑ সেই প্রশ্নই এখন সবার মুখে মুখে। তবে বর্তমান বেশিরভাগ এমপিই আবার নৌকার মাঝি হচ্ছেন, অজনপ্রিয় ও বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে সেখানে নতুন মুখ হিসেবে আনা হচ্ছে তরুণ নেতাদের। সবকিছু মিলিয়ে আওয়ামী লীগের এবারের মনোনয়ন তালিকায় অনেক আসনেই চমকের প্রার্থী আনছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা।
গত দুই নির্বাচনের চেয়ে এবার প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা নিয়ে কঠোর গোপনীয়তার পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, সবার মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কারণ চ্যালেঞ্জিং এই নির্বাচনের নানা অঙ্ক মাথায় রেখেই চলছে আওয়ামী লীগে আসনভিত্তিক প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে জোট শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টিও। রাজনৈতিক কৌশলগত কারণেই এবার আগেভাগে দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে চায় না আওয়ামী লীগ। সবদিক দেখে এবং জোট ও ভোটের হিসাব মিলিয়েই তিনশ’ আসনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে আগামীকাল রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রার্থিতা ঘোষণা করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে শুক্রবার দ্বিতীয় দিনের মতো অনুষ্ঠিত দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আরও চারটি বিভাগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রথম দিন রাজশাহী ও রংপুরের ৭২টি আসনের দলীয় প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়। শুক্রবার যেসব বিভাগের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়েছে কৌশলগত কারণে তা প্রকাশ করা হয়নি।
তবে একাধিক সূত্র থেকে আভাস পাওয়া গেছে, দ্বিতীয় দিনের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের প্রথম দফার বৈঠকে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়। দ্বিতীয় দফার বৈঠকে ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ আসনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ছয় বিভাগের মধ্যে অধিকাংশ বর্তমান মন্ত্রী-এমপি পুনরায় মনোনয়ন পেলেও কিছু অজনপ্রিয়, বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং নানা কারণে বিতর্কিত কিছু এমপির কপাল পুড়েছে। সেসব জায়গায় নতুন মুখ হিসেবে তরুণ প্রার্থীরাই প্রাধান্য পেয়েছেন। এই ছয় বিভাগের মোট আসনের সংখ্যা ১৭২টি। আজ শনিবার তৃতীয় দিনের বৈঠকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের দলীয় প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে বলে সূত্রটি জানায়।
বৈঠক শেষে বিকেলে ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ব্রিফিংকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজশাহী ও রংপুরের পর শুক্রবারের বৈঠকে আরও চারটি বিভাগের দলীয় প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখানে নতুন অনেকে এসেছেন, কিছু বাদও পড়েছেন। তবে উইন্যাবল (জনপ্রিয়) প্রার্থী আমরা বাদ দেইনি। যারা বিজয়ী হতে পারবে না, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন; নারী-পুরুষ সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই মনোনয়নে এটা প্রযোজ্য।
কৌশলগত কারণে কোন কোন বিভাগের মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে, তা প্রকাশ করা হচ্ছে না উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, একসঙ্গে তিনশ’ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। দুইটা দিন অপেক্ষা করুন। শনিবার না হলেও, রবিবারের মধ্যে ৩০০ আসনের চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, আমরা যখন বিভাগের নাম ঘোষণা করি তখন ভিড় বেড়ে যায়, নির্দিষ্ট বিভাগ শুনলে পিড়াপীড়ি শুরু হয়ে যায় কীভাবে চূড়ান্ত প্রার্থীদের নাম বের করা যায়। সে কারণে বিভাগের নাম আমরা ঘোষণা করছি না।
দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হলেও কেন ঘোষণায় দেরি হচ্ছে, এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা মনোনয়নের ব্যাপারটা সুনির্দিষ্ট করে এখনো বলছি না, কারণ এর মধ্যে আমরা যেসব প্রার্থী দিয়েছি, সেসব মনোনয়নে ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। সেটাও সংশোধনের একটা সুযোগ রেখেছি। এ কারণে আমরা ঠিক করেছি ভিন্নভাবে, অর্থাৎ জেলাওয়ারি বা বিভাগওয়ারি প্রার্থিতা ঘোষণা করব না। একসঙ্গে ৩০০ আসনের প্রার্থিতা ঘোষণা করতে চাই।
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কত নায়ক-নায়িকা এখন এমপি। তারা তো সরাসরি দল করে না। ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশেও আছে। আর সাকিব আল হাসান রাজনীতি করবে, জনগণের সেবা করবে। বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে সে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না সে কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাদের (বিএনপি) নির্বাচনে অংশ নেওয়ার এখনো সুযোগ রয়েছে। হয়তো বিএনপি দলীয়ভাবে, জোটগতভাবে নাও আসতে পারে। বিএনপির ভেতর থেকে অনেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের কাছে খবর আছে- অনেকেই তারা প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবে।
এ সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেনসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
জনপ্রিয়-ত্যাগী নেতারাই হচ্ছেন নৌকার মাঝি ॥ কারা মনোনয়ন পাচ্ছেন তার চেয়ে কোন কোন প্রার্থীর এবার কপাল পুড়ছেÑ সারাদেশের নেতাকর্মীদের এটাই একমাত্র জানার আগ্রহ। শুধু দলটির নেতাকর্মীরাই নয়, রাজনৈতিক সচেতন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে ফোন করে তাদের নিজ নিজ আসনে কে কে মনোনয়ন পেয়েছেন তা ফোনের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছেন।
বর্তমান এমপিদের মধ্যে কতজন বাদ পড়েছেন- এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কয়েকজন বাদ পড়েছে, সেখানে এসেছে নতুন মুখ। আর প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। দলীয় মনোনয়নের বেলায় তরুণরাও গুরুত্ব পাচ্ছেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে দলের অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেখা যাক কারা বিদ্রোহী প্রার্থী হন। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের বেলায় কঠোরভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। তারা সাংবাদিক ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের এড়িয়ে চলছেন। কয়েকজন এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশী জানান, মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা মুখ খুলছেন না। এমনকি ফোনেও কথা বলছেন না। কেউ কেউ ফোন বন্ধ রেখেছেন। কেউ ফোন রিসিভ করলেও দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে মুখ খুলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এ অবস্থায় দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য কোন প্রার্থীর নাম বলতে অপরাগতা প্রকাশ করে জানান, প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনের বৈঠকেও দুই বিভাগের বেশির ভাগ বর্তমান এমপি আবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। বর্তমান এমপিদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন বাদ পড়েছেন। অজনপ্রিয়, অদক্ষ ও নানা কারণে বিতর্কিত হওয়ায় তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
তিনি এও জানান, নতুনদের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছেন অপেক্ষাকৃত তরুণরা। বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম ও পত্রিকায় প্রকাশিত নামের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব ঠিক নয়। চূড়ান্তভাবে ঘোষণার আগে কেউ-ই নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না যে সে মনোনয়ন পেয়েছেন। সবকিছু আগামীকাল রবিবার দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট করা হবে।
এদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে চূড়ান্তকৃত চারটি বিভাগের বিভিন্ন আসন নিয়ে নানা ধরনের গুজব-গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুকের মাধ্যমে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পক্ষ থেকে দলের মনোনয়ন পাওয়ার তথ্য জানানো হচ্ছে। এমনকি এক আসনে একাধিক ব্যক্তির পক্ষ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার দাবি করা হচ্ছে। এ নিয়ে অধিকাংশ আসনেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো আসনে পছন্দের মনোনয়নপ্রত্যাশী মনোনয়ন পেয়েছেন বলে মিষ্টি বিতরণের ঘটনাও ঘটছে। এ নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সংসদীয় বোর্ড ও আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, এখন তিনশ’ আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকবে, এটা বিবেচনায় নিয়েই প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। ১৪ দলীয় জোটের শরিক ও মিত্রদের যেসব আসন ছেড়ে দেওয়া হবে, সেগুলো থেকে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। সেজন্য আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর দলীয় প্রার্থীদের কাছে দলের প্রধান শেখ হাসিনার স্বাক্ষর সম্বলিত প্রতীক বরাদ্দের চিঠি প্রদানের সময় চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাওয়া নৌকার মাঝিদের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারেরও একটি করে চিঠি নেওয়া হবে।
সূত্র আরও জানায়, মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দুটি জরিপ গুরুত্ব দিচ্ছেন। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বিশ্বস্ত কিছু দলীয় ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিকে দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে মাঠ জরিপ করিয়েছেন। এসব জরিপ রিপোর্টে যেসব মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের ব্যাপারে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, তৃণমূলে কোন্দল-দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। তবে সেই সংখ্যা খুব বেশি নয়। সংখ্যাটি ২০ জনের বেশি হবে না।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর চার দিনে ৩ হাজার ৩৬২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ। ৩০০ আসনের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ এই আবেদন থেকে টানা বৈঠক করে প্রার্থী তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর; বাছাই ১-৪ ডিসেম্বর।
তবে রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি নির্বাচনে আসতে চাইলে সেক্ষেত্রে ঘোষিত তফসিল কিছুটা পুনর্গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। শেষ মুহূর্তে কোনো দল ভোটে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিতে পারে। বিএনপি না আসলেও বেশিরভাগ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ তাদের মিত্রদের ভোটে আসার ব্যাপারে ইতোমধ্যে গ্রিনসিগন্যাল দিয়েছে। এজন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় কিছুটা বাড়তে পারে। তবে ভোটের তারিখ পরিবর্তনে আগ্রহী নয় আওয়ামী লীগ।