মিলছে না ১৪ দলের শরিকদের চাওয়া পাওয়ার হিসাব
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলছে না আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে। এ নিয়ে প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় সংশয়ে অন্য দলগুলো। এর মধ্যে শরিকদের আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণা এবং সব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখার সিদ্ধান্তে ধোঁয়াশায় পড়েছে দলগুলো।
এ পটভূমিতে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের দিকেই তাকিয়ে আছে শরিকরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসন সমঝোতার আশায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় রয়েছে তারা। নতুন করে যুক্ত নির্বাচনী মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হলেও এখন পর্যন্ত ১৪ শরিককে ডাকেননি প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সংসদে দুটি আসনের অধিকারী মহাজোট শরিক বিকল্পধারা বাংলাদেশের সঙ্গেও বসার উদ্যোগ নেয়নি আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে অনেকটাই হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে এসব দলে। মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রশ্নটি এখনও অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।
তবে ১৪ দল শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ অবস্থান হচ্ছে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় পার হওয়ার পরই জোট শরিকদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনের আগেই পরিস্থিতি অনুযায়ী কাকে কোন আসনে ছাড় দেওয়া হবে– সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। এ ক্ষেত্রে সমঝোতা হওয়া আসনগুলোতে দলীয় প্রার্থীদের সরিয়ে শরিকদের নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হবে। অবশ্য নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করতে শরিক দলগুলোকে ‘সামর্থ্য অনুযায়ী’ সমঝোতা হওয়া আসনগুলোর বাইরেও সর্বোচ্চসংখ্যক আসনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এদিকে, সারাদেশে দল থেকে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হওয়ার আগের নির্দেশনা থেকেও কিছুটা সরে এসে আওয়ামী লীগ। দলটি বলছে, এখন আর ‘পাইকারি হারে’ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমোদন দেওয়া হবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী ‘কৌশলগত কারণে’ কিছু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখা হবে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এর আগে গত রোববার দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠকে একটি আসনেও কেউ যেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না পারেন, সে লক্ষ্যে দলীয় নেতাকর্মীকে ‘ডামি প্রার্থী’ তথা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক মন্ত্রী-এমপির পাশাপাশি মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা ‘গণহারে’ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে শুরু করেন। এ নিয়ে সৃষ্ট ‘হযবরল পরিস্থিতি’ ও দলীয় বিশৃঙ্খলা ঠেকাতেই নতুন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এমনটাই জানিয়েছে দলীয় সূত্রগুলো।
গতকাল মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও দলের সর্বশেষ অবস্থান তুলে ধরেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘৩০০ আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকবে। তবে সমঝোতা হলে জোটের শরিকদের কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি সমন্বয় করা হবে।’ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপিদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে নির্বাচন ফ্রি-স্টাইল হবে না, আমরা দেখি কারা কারা চাইছেন। সেটার ওপর আমাদের একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত আছে।’
এর পরও সংশয় কাটছে না ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের। এসব দলের কয়েকজন নেতা সমকালকে বলেন, আসলে আওয়ামী লীগের অবস্থান এখনও পরিষ্কার নয়। যখন যে সিদ্ধান্তই নিচ্ছে তারা, সেটা নিয়ে শরিকদের সঙ্গে আলোচনাও করছে না। আসন সমঝোতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের তরফে এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে বসার উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। তবে জোটের প্রধান নেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের কথা জানানো হয়েছে। গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর সময় দেওয়া সাপেক্ষে রবি বা সোমবার বৈঠকের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। এ বিষয়ে এরপর আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। তবু দুই-এক দিনের মধ্যেই শেখ হাসিনার সঙ্গে ওই বৈঠকের আয়োজন করা হবে– এমনই প্রত্যাশা তাদের।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আগে থেকেই সিদ্ধান্ত রয়েছে জোটগত নির্বাচনে যাবে ১৪ দল। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো উদ্যোগ দেখছি না।
আরেক শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, যে কোনো সময়ই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ১৪ দল শরিকদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। সেখানেই সব বিষয়ে ফয়সালা হবে বলে মনে করছি।
জাতীয় পার্টি-জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম একই মত দিয়ে বলেন, আমরাও প্রধানমন্ত্রীর ডাকের অপেক্ষায় আছি। সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, এখনও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে কোনো বৈঠক হয়নি। আমরা অপেক্ষায় আছি, দ্রুত বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
গণতন্ত্রী পার্টির একাংশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, আশা করি, ১৪ দলের নেত্রী দ্রুতই আমাদের নিয়ে বসে আসন বণ্টন করবেন।
এত শঙ্কা দূর হবে কীভাবে
আসন ভাগাভাগি নিয়ে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও উত্তর জানা নেই। এবার দুটি বাদে সবক’টিতেই প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে একাধিক উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের পদ ছেড়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দিয়েছেন। এ ছাড়াও প্রায় প্রতিটি আসনেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
জোটের শরিকদের মধ্যে শেষ মুহূর্তে আসন ভাগাভাগি হলেও যারা বর্তমান চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে মনোনয়ন সংগ্রহ করছেন, তাদের কী হবে। দলীয় প্রার্থীদের বসানো সম্ভব হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় সরানো হবে। এবারের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ সব আসনে ভোট চায়। সেই বিবেচনায় এসব আসনে শরিকদের নৌকা প্রতীক দিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা থেকে যেতে পারেন। শরিকদের ভয় এখানেই। স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা স্বতন্ত্র দাঁড়ালেও তাদের জন্য ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে এসব আসনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলে শরিকদের জয়ের আশা আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বর্তমান সংসদে জোট শরিকদের সাতটি আসন রয়েছে। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির তিনটি, জাসদের দুটি, তরীকত ফেডারেশনের একটি এবং জাতীয় পার্টি-জেপির একটি। পাশাপাশি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বি. চৌধুরীর দল বিকল্পধারাও গত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে। যদিও তারা ১৪ দলে নেই। বর্তমান সংসদে তাদের দুটি আসন রয়েছে।
আসনগুলোর মধ্যে কুষ্টিয়া-২ আসনের বর্তমান এমপি জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিলেও স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
ফেনী-১ আসনের বর্তমান এমপি জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। এ আসনে প্রভাবশালী প্রার্থী আলাউদ্দিন আহমদ চৌধুরী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এ ছাড়া ফেনী জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি শাহরিয়ার ইকবালও প্রার্থী হচ্ছেন। শিরীন আখতার গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দুটি। এর মধ্যে একটিতে তিনি জাসদের প্রার্থী এবং আরেকটিতে তিনি ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বগুড়া-৪ আসনের এমপি রেজাউল করিম তানসেন। গত বছর বিএনপির এমপিদের পদত্যাগের পর তিনি উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন হেলাল উদ্দিন কবিরাজ। এ ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন রানা।
ঢাকা-৮ আসনের বর্তমান এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এ আসনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে এখনও কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেননি।
রাজশাহী-২ আসনের বর্তমান এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী। এ আসনেও এখন পর্যন্ত কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেননি।
সাতক্ষীরা-১ আসনের বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন কলারোয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি। এর বাইরে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সরদার মুজিব স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
পিরোজপুর-২ আসনের বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কানাই লাল বিশ্বাস। তবে এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজ।
চট্টগ্রাম-২ আসনের বর্তমান এমপি তরীকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন খাদিজাতুল আনোয়ার সনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান এইচ এম আবু তৈয়ব।
মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের বর্তমান এমপি মাহি বি চৌধুরী। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সিরাজদীখান উপজেলা চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ। পদ ছেড়ে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া এই আসনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম সারওয়ার কবির স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের এমপি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ইস্কান্দার মির্জা শামীম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন কিনেছেন।
এ ব্যাপারে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে আজও বলা হয়েছে, শরিকদের সঙ্গে সমঝোতা করা হবে। সমঝোতার আসনগুলো থেকে দলীয় প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরিয়ে নেওয়া হবে। এখন দেখা যাক, পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়।
আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে শরিকরাও
এর আগে বিএনপিহীন নির্বাচনের সম্ভাবনা থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘দরকষাকষির’ মাধ্যমে যত বেশি সংখ্যক আসনে ছাড় পাওয়া সম্ভব, সেটাই করা হবে বলে মনে করছিল ১৪ দল শরিকরা। তবে এরই মধ্যে ১৪ দল ও মহাজোটের বাইরেও অনেক দল বিশেষ করে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফ, বিএসপি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ অনেক ইসলামী দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা করেছে। ২৯৮ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৪ দল শরিকদের চাপে রেখে কম আসনে সমঝোতায় আসতে বাধ্য করার জন্যই এটি করা হয়েছে বলেও মনে করছে শরিক দলগুলো।
এর পরও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ‘বাস্তবতাকে’ বিবেচনায় আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে ১৪ দল ও মহাজোট শরিকরা। বিশেষ করে বিএনপিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘সমর্থন’ ছাড়া ভোটের মাঠে এককভাবে লড়াইয়ে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য নিয়েও সংশয় রয়েছে সব শরিক দলের। ফলে বেশি সংখ্যক আসনে ছাড় আদায় করা হলেও জয়ী হয়ে আসা কঠিন বলেও মনে করছে তারা। এ অবস্থায় আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এখন আর কোনোরকম ‘দরকষাকষিতে’ যেতেও রাজি নয় তারা। শুধু বর্তমান সংসদে নিজেদের দখলে থাকা আসনগুলোর সঙ্গে আরও দু-চারটি আসন বাড়িয়ে নেওয়ার নীতিতেই এগোচ্ছে শরিক দলগুলো। অন্যদিকে সমঝোতা হওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রতীক ‘নৌকা’ এবং দলীয়ভাবে আরও অনেক আসনে নিজ নিজ প্রতীক নিয়ে লড়ার প্রস্তুতিও রয়েছে তাদের।
২০১৮ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি পাঁচটি আসনে ছাড় পেলেও তিনটিতে জিতেছিল। দলটি বর্তমান এই তিন সংসদ সদস্য ঢাকা-৮ আসনে দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন, রাজশাহী-২ আসনে সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এবং সাতক্ষীরা-১ আসনে অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ ছাড়াও নাটোর-৩ আসনে ইব্রাহিম খলিল ও মেহেরপুর-২ আসনে পলিট ব্যুরোর সদস্য নুর আহমেদ বকুলের জন্য ছাড় চাইবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাড় পেলে এসব আসনে নৌকা নিয়ে লড়বে তারা। এ পাঁচটি আসনসহ মোট ৩০টিতে প্রার্থী দিয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি। ছাড় পাওয়া আসনগুলো বাদে বাকিগুলোতে দলীয় প্রতীক হাতুড়ি নিয়ে লড়বে দলটি।
একইভাবে জাসদ গত নির্বাচনে পাঁচটি আসনে ছাড় পেলেও জিতেছিল দুটিতে। পরে উপনির্বাচনে আরেকটি আসনে জিতে তাদের আসন দাঁড়ায় তিনটি। আগামী নির্বাচনে বর্তমান এমপিদের মধ্যে দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর কুষ্টিয়া-২, সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের ফেনী-১ এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য রেজাউল করিম তানসেনের বগুড়া-৪ ছাড়াও আর দুটি আসনের জন্য আলোচনায় যাবে জাসদ। এসব আসনসহ দলীয়ভাবে ১৮১ আসনে প্রার্থী দিয়েছে দলটি, সমঝোতার আসনগুলোর বাইরে দলীয় প্রতীক মশাল নিয়ে নির্বাচন করবে দলটি।
জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পিরোজপুর-২ আসন ছাড়াও সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলামের জন্য একটি আসন নিশ্চিত করতে চাইছে দলটি। আরও কয়েকটি আসনে দলীয় প্রতীক বাইসাইকেল নিয়ে লড়বে দলটি। তরীকত ফেডারেশন ২০০ আসনে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কাছে দলের চেয়ারম্যান ও বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর চট্টগ্রাম-২ আসন ছাড়াও মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর জন্য কুমিল্লা-৮ কিংবা কুমিল্লা-৯ আসনের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চাইছে দলটি।
সাম্যবাদী দল সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়ার চট্টগ্রাম-১ আসনটি নিশ্চিত করতে চাইছে। এগুলোসহ মোট ১০ আসনে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে তারা। ১৪ দলের অন্য শরিকদের মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, দুই ভাগে বিভক্ত গণতন্ত্রী পার্টি (আরশ আলী) ও গণতন্ত্রী পার্টি (শাহাদাৎ) আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার অপেক্ষায় রয়েছে। আর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনহীন গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং বাসদ (রেজাউর) আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে আছে। এরই মধ্যে বাসদের চার নেতা এবং গণআজাদী লীগের এক নেতা আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনে জমাও দিয়েছেন।
মহাজোট শরিক বিকল্পধারা এবারের নির্বাচনেও তাদের বর্তমান দুই এমপি দলের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের লক্ষ্মীপুর-৪ এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরীর মুন্সীগঞ্জ-১ আসনটি নিশ্চিত করতে চাইছে।
এদিকে, সংসদে আসন থাকা দলগুলোর বাইরের ১৪ দল শরিকরা কমপক্ষে একটি করে আসন চাইছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য– ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে এমনটাই আশ্বাস দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ বছরের ১৯ জুলাই গণভবনে ওই বৈঠকটি হয়েছিল।
এ ব্যাপারে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমরা আমাদের বর্তমান তিন এমপি ছাড়াও আরও দুটি আসনে ছাড় চাইব। কেননা এই দুটি আসনেও আমাদের শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছে।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আমরা আমাদের বর্তমান তিন এমপির জন্য আসন চাইব। এর সঙ্গে আরও দু-চারটি বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।
বাসদের (রেজাউর) আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান বলেন, ১৪ দল নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে প্রধানমন্ত্রীই আমাদের জানিয়েছিলেন– আগামী নির্বাচনে প্রতিটি শরিক দলকে অন্তত একটি আসন দেওয়া হবে। আমরা সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছি।
সার্বিক বিষয়ে ১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, আসন সমঝোতার বিষয়ে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হলেই এ বিষয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে যাবে।