Bangladesh

নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে ছোট দলগুলোর বড় ভূমিকা!

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৩ হাজারেরও বেশি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছিল। আর এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি ফর্ম বিক্রি হয়েছে। এবার নতুন উদ্যমে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে ছোট দলগুলো। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৩৭টি আসনের সবকয়টিতেই পরাজিত হয়েছিল জাকের পার্টি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ঘটেছে শোচনীয় পরাজয়। এবার আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিয়েছে দলটি। যা দলটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। 

১৯৯১ সালে জাকের পার্টি যখন প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন দলটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ২৫১টি আসনেই পরাজিত হয়। 

দলটি ঐ নির্বাচনে মোট ভোটের মাত্র ১ দশমিক ২২ ভাগ ভোট পায়। সংখ্যার হিসেবে যা মোট প্রদত্ত ৩ কোটি ভোটের মধ্যে মাত্র প্রায় ৪ লাখ।

২০১৮ সালের নির্বাচনে ৮৯টি সিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাকের পার্টি। সেখানে মাত্র এক লাখের মতো ভোট পায় দলটি। 

এবার আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিয়েছে দলটি। যা দলটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। 

শুধু তাই নয়, একক রাজনৈতিক দল হিসেবে জাকের পার্টির প্রার্থীর সংখ্যা এবার সর্বোচ্চ। ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগ ২৯৮ এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবার ২৮৭ জন প্রার্থী ঘোষণা করেছে।  

১৯৮৯ সালে হাশমতুল্লাহ ফরিদপুরী দলটি গঠন করেন। যিনি ব্যাপকভাবে ‘আটরশি পীর’ নামে পরিচিত। এবারের নির্বাচনে জাকের পার্টির মতো আরও কিছু দল আছে যারা এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখাচ্ছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য দলগুলোর আন্দোলন চলছে। অন্যদিকে বেশ কয়েকটি দল বহু আসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী নিয়ে নির্বাচনে লড়তে যাচ্ছে।

প্রার্থী দেওয়ার দৌড়ে যুক্ত হয়েছে সদ্য নিবন্ধন পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিও পিছিয়ে নেই। এছাড়াও রয়েছে বহু স্বতন্ত্র প্রার্থী।

এখন পর্যন্ত ৩০০ আসনের জন্য ২৬টি রাজনৈতিক দল প্রায় ৩ হাজার প্রার্থী দিয়েছে। যদিও গত নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৩,০৬৫ জন।

ছোট রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থীরা বিগত নির্বাচনগুলোতে জয়লাভ করতে না পারলেও আসন্ন নির্বাচনে দলগুলোর অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়ছে। আবার সরকার ও নির্বাচন কমিশন উভয়ের পক্ষ থেকেই ‘অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

গত নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৩৯টি দলের মধ্যে ৩০টি দলই কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। ওই ৩০টি দলের মধ্যে অধিকাংশই ফের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কিন্তু এই দলগুলো আসলে কারা? তারা কি এবারের নির্বাচনে বড় বাজি ধরছে? না-কি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে?

২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৩৭টি আসনের সবকয়টিতেই পরাজিত হয়েছিল জাকের পার্টি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ঘটেছে শোচনীয় পরাজয়। তবুও এবারের নির্বাচনে দলটি পূর্ণ বিজয়ের আশা করছে।

দলটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এজাজুর রাসুল বলেন, “এবারই প্রথম আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছি। আশা করি আমাদের প্রার্থীরা জয়ী হবেন।”

জাকের পার্টির নির্বাচনী ভাবনা যেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই দলটিও নির্বাচনে আগের তুলনায় সর্বাধিক সংখ্যক প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৯৭২ সালে গঠিত প্রধান দল জাসদ (ইনু) এবারের নির্বাচনে ১৮১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। দলটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটেও রয়েছে; যদিও ক্ষমতাসীনদের ছেড়ে দেওয়া কোনো আসন দলটি পায়নি।

জাসদ (ইনু) দলটি এর আগে নিজেদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জয়ী হতে পারেনি। এমনকি মোট ভোটের মাত্র ০.৫ ভাগ ভোট পেয়েছিল দলটি। 

২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটির প্রায় ১২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এরমধ্যে দলটির প্রেসিডেন্ট হাসানুল হক ইনু ও সদস্য শিরিন আখতার আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করেছেন। 

ঐ নির্বাচনে ইনু কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে এবং শিরিন আখতার ফেনী-১ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকি ১০ জন প্রার্থী মাত্র ১,২৫,৪৯৪ টি ভোট পেয়েছিল। 

২০০১ সালের নির্বাচনে দলটি ৭৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যদিও সবকয়টি আসনে পরাজিত হয়েছিল দলটি। 

এ সম্পর্কে হাসানুল হক ইনু বলেন, “বেশিরভাগ আসনে আমাদের নিজস্ব প্রতীক ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হবে। তবে কিছু আসনে আমরা ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো নৌকা নিয়ে লড়ব।”

হাসানুল হক ইনু আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে জোর দিয়ে বলেন, তাদের দলের প্রার্থীর সংখ্যা আগের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে বেশি হবে।

নির্বাচনী মৌসুমে এই ধারায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট। দলটি ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটি দুইটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সেখানে মাত্র ১,২১৯ টি ভোট পায় তারা। কিন্তু এবারের নির্বাচনে দলটি ২০০ এরও বেশি প্রার্থী দেবে। 

দলটির প্রধান আবু লায়েস মুন্না বলেন, “বেশ কয়েকটি জোট আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে এবং সবাই আমাদের দলীয় প্রতীক (লাঠি) নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আমরা ২৫০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছি। তাই আমরা আশা করছি ২০০টিরও বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পারব।”

অন্যদিকে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ‘ফুলের মালা’ প্রতীক নিয়ে ১২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তবে দলটি ব্যতিক্রম হিসেবে এর আগে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির ১৭ জন প্রার্থী ছিল। সেখানে প্রায় ১০ কোটি প্রদত্ত ভোটের মধ্যে দলটি ২.৪৪ লাখ ভোট পেয়েছিল।  

ঐ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন দলটির প্রধান নাজিবুল বাশার মাইজভাণ্ডারী। তিনি ২ লাখ ৩৮ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। আর দলটির বাকি ১৬ জন প্রার্থী নিজেদের প্রতীক নিয়ে সবমিলিয়ে মাত্র ৬ হাজার ভোট লাভ করে।   

যদিও ২০১৪ সালের নির্বাচনে তরিকত ফেডারেশন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তারা ঐ নির্বাচনে দুইটি আসনে জয়লাভ করে। 

দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, “আমরা জোটগতভাবে নির্বাচন করছি। এ জোট ১৩টি আসন চেয়েছে। আমাদের দল জোটের বাইরের প্রার্থীদেরও মনোনয়ন দেবে। একটু সময় পেলে আমরা ২০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারতাম।”

দলটি কীভাবে এত বেশি সংখ্যক প্রার্থী দিচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, “সারাদেশে আমাদের কর্মী রয়েছে। সেখানে আমাদের কমিটিও রয়েছে।”

অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) মোট ৭০টি আসনে প্রার্থী দেবে। যদিও ২০১৮ সালে তারা ৫৭টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। 

অন্যদিকে বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট মোট ৩০০টি মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছে। এরমধ্যে ১০০টি আসনে তারা প্রার্থী দেবে বলে ধারণা করা হয়েছে।  

২০১৮ সালে দলটি ২৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। যদিও সবগুলো আসনেই পরাজিত হয়েছিল দলটি। তারা ভোট পেয়েছিল মাত্র ৬০,৩৭২টি।

নির্বাচনে যাওয়া ২৬টি দলের মধ্যে রয়েছে নতুন নিবন্ধন পাওয়া তিনটি দল তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ ন্যাশলানিস্ট মুভমেন্ট ও বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টি। দলগুলো যথাক্রমে ২৮০, ২৫০ ও ১২১টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। মোট ৬৫১টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে তারা।

বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ২০১৫ সালে তৃণমূল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দলটিকে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন দিতে তিনি বেশ সংগ্রাম করেছেন। অবশেষে নিবন্ধন পাওয়ার মাত্র তিনদিন আগে গত ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট চলতি বছরের আগস্টে ‘নোঙর’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়। দলটিতে রয়েছে জাতীয় পার্টির একজন সাবেক সংসদ সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং পুলিশের একজন সাবেক ডিআইজি।

অন্যদিকে বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টি ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সারাদেশে রাজনৈতিক দলটির প্রায় ৫০০ অফিস রয়েছে বলে দাবি করা হয়। দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন সাইয়েদ সাইফুদ্দিন আহমেদ আল হাসানী। 

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৩ হাজারেরও বেশি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছিল। আর এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি ফর্ম বিক্রি হয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button