Bangladesh

ঢাকার মাঠে দেখা নেই নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বীদের

ভোটের প্রচার পাঁচ দিন আগে শুরু হলেও রাজধানীর ১৫টি সংসদীয় আসনের তিনটি বাদে অন্যগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দেখা নেই। নৌকার ব্যানার, ফেস্টুন, মিছিল ও মাইকিং থাকলেও গতকাল শুক্রবার ঢাকা-৬, ৭, ৮, ১২ ও ১৩ আসন ঘুরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রচারসামগ্রীর দেখা মেলেনি।

জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু আওয়ামী লীগকে হারিয়ে সরকার গঠনের স্বপ্নে বিভোর থাকার কথা বললেও ১৫টি আসনের চারটিতে লাঙ্গলের কোনো প্রার্থী নেই। বাকি ১১ আসনের মোটে তিনটিতে জাপার প্রার্থীদের প্রচারের খোঁজ পাওয়া গেল।

ঢাকা-৪, ৫ ও ১৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া তিন নেতা নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হয়ে লড়ছেন। ভোটের মাঠেও তারা জোরেশোরে রয়েছেন। ঢাকা-১৬ ও ১৭ আসনে একজন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও তাদের আওয়াজ নেই। প্রচারও চোখে পড়েনি।

জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরকে ঢাকা-১৮ আসন ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে আওয়ামী লীগ। এ আসনে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক খসরু চৌধুরী স্বতন্ত্র হয়ে লাঙ্গলের বিপক্ষে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছেন ‘কেটলি’ প্রতীকে।

ঢাকা-৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩ ও ১৫ আসনে নৌকার মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। ফলে মাঠে আওয়ামী লীগের কার্যত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। যদিও প্রতিটি আসনে সর্বনিম্ন পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১৩ জন করে প্রার্থী থাকলেও নামসর্বস্ব দলগুলোর আওয়ামী লীগকে টক্কর দেওয়ার অবস্থা নেই। রাজধানীতে ১৮টি রাজনৈতিক দলের ১০৭ এবং ছয়টি আসনে ১৫ স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। ভোটাদের ভাষ্য অনুযায়ী, নৌকার প্রার্থী এবং কয়েকজন স্বতন্ত্র ছাড়া সবাই ‘ডামি’।

রাজধানীর যে ৯টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই, ঢাকা-১০ (হাজারবাগী, ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট) আসন তার একটি। এ আসনেই সবচেয়ে কম, পাঁচ প্রার্থী এমপি হওয়ার দৌড়ে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদের নৌকার বিপক্ষে ভোটে আছেন জাপার হাজী মো. শাহজাহান, ‘আম’ প্রতীকে এনপিপির কে এম শামসুল ইসলাম, ‘ছড়ি’ প্রতীকে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী ড. শাহরিয়ার ইফতেখার ফুয়াদ ও ‘টেলিভিশন’ প্রতীকে বিএনএফের বাহারানে সুলতান বাহার।

একমাত্র শাহরিয়ার ইফতেখারের কয়েকটি পোস্টারের দেখা পাওয়া গেল নিউমার্কেটের সামনে মিরপুর সড়কে। কিন্তু তাঁর কর্মী-সমর্থকদের দেখা নেই। শুক্রবার বিকেলে খবর পাওয়া গেল, জিগাতলার ট্যানারি মোড়ে খোলা পিকআপে ছড়ির প্রচার চলছে। গিয়ে দেখা গেল, নৌকার প্রচার মিছিলকে পথ করে দিয়ে পিকআপটি দাঁড়িয়ে আছে ট্যানারি মোড় শাহি মসজিদের সামনে। পিকআপে মাইক বাজাচ্ছেন দু’জন। তারা জানালেন, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট দলের কথা শোনেনি। ভাড়ায় প্রচার চালাচ্ছেন।

ঢাকা-৬ আসনে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ ১০ বছর ধরে এ আসনের এমপি। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় না পেয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। খোলাখুলি বলেছেন, নৌকার সঙ্গে পেরে ওঠার সামর্থ্য তাঁর নেই।

সাঈদ খোকনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন ছয়জন। ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), জাতীয় পার্টি (জেপি-মঞ্জু), গণফ্রন্ট, মুক্তিজোট, তৃণমূল বিএনপি এবং ইসলামী ঐক্যজোট প্রার্থী দিয়েছে কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর থানা নিয়ে গঠিত এ আসনে। তবে তাদের কাউকে ভোটের প্রচারে পাওয়া গেল না। জেপি এবং ইসলামী ঐক্যজোট অতীতের নির্বাচনগুলোতে দু-একটি করে আসন জিতলেও, বাকিগুলো এখনও সংসদে যেতে পারেনি। বাংলাবাজারের বইয়ের ব্যবসা করা মাসুদ শিকদার বললেন, নৌকা বাদে সবাই ডামি প্রার্থী। পাঁচ দিনের এক দিনও আসেনি ভোটের প্রচারে।

রাজধানীতে নৌকার প্রার্থী রয়েছেন ১৪ জন। আম প্রতীকে এনপিপি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। ভোটের প্রচারের কী অবস্থা– এ প্রশ্নে এনপিপি নেতা শেখ সালাহউদ্দিন ছালু সমকালকে বলেন, শুক্রবার থেকে প্রচার শুরু হয়ে গেছে। আসলে বৃহস্পতিবার রাতে পোস্টার ছাপার কাজ শেষ হয়েছে। প্রত্যেক প্রার্থীকে দল থেকে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার করে পোস্টার দেওয়া হয়েছে। প্রার্থীরা নিজেরা লিফলেট ছাপাচ্ছে। শেখ সালাহউদ্দিন ছালুর বাড়ি গোপালগঞ্জে। তিনি নিজে প্রার্থী নন। ঠাকুরগাঁওয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে কী হচ্ছে– আপনিও বোঝেন, আমিও বুঝি।’

ঢাকা-৪ আসনে নৌকার সানজিদা খানমের বিরুদ্ধে ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতির সাবেক সহকারী একান্ত সচিব মো. আওলাদ হোসেন। এ আসনের ১০ বছরের এমপি জাপার সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা লাঙ্গল প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন। একমাত্র এ আসনেই নৌকা ও লাঙ্গল সমানে সমান প্রচার চালাচ্ছে। শক্তভাবে ট্রাকও। বাকি ছয় দলের প্রার্থীদের প্রচার দেখা যায়নি।
ঢাকা-৫ আসনে নৌকার হারুনুর রশিদ মুন্নার বিরুদ্ধে ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে মসিউর রহমান মোল্লা সজল। ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল হাসানও প্রচারে রয়েছেন। বাকি আট প্রার্থীর খবর নেই।

লালবাগ, বংশাল, ইসলামপুর থানা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৭ আসনে প্রার্থী ছয়জন। শুক্রবার দেখা গেল, নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমের প্রচারসামগ্রীতে তিন থানায় ছেয়ে গেছে। নাজিরাবাজার এলাকায় লাঙ্গলের সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলনের কিছু পোস্টার ও ব্যানার পাওয়া গেল। বাকি চার প্রার্থীর প্রচারসামগ্রী বলতে কিছুই নেই।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক হয়ে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পাওয়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ রাজধানীর যে তিনটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে, তার একটি ঢাকা-৭। কিন্তু মশালের প্রার্থী হাজী ইদ্রিস ব্যাপারীর প্রচারসামগ্রীর নাম-নিশানাও সংসদীয় আসনে খুঁজে পাওয়া গেল না। ১৪ দলের আরেক শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির একজন প্রার্থীও নেই ঢাকায়।
রাজপথে সক্রিয় দলগুলোকে পেছনে ফেলে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়ে ‘কিংস পার্টি’র তকমা পাওয়া বিএসপি রাজধানীর যে ৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে, তার একটি ঢাকা-৭। দলটির প্রার্থী আফসার আলী জানালেন, নিজের মতো করে প্রচার চালাচ্ছেন। ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকে রাজধানীর ১০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। আরেক ‘কিংস পার্টি’ বিএনএম ‘নোঙর’ প্রতীকে প্রার্থী দিয়েছে একটি আসনে।

ঢাকায় দলের কতজন প্রার্থী আছেন, তা জানেন না তৃণমূল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আক্কাস আলী খান। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘সারাদেশে ১৪৮ আসনে প্রার্থী আছে। ঢাকায় প্রচারের কী অবস্থা, প্রার্থীদের কাছ থেকে জেনে জানাতে হবে।’

আটটি আসনে ‘ছড়ি’ প্রতীকে মুক্তিজোটের প্রার্থী রয়েছে। দলের প্রধান আবু লায়েস মুন্না বলেছেন, ‘প্রচুর প্রচার চলছে।’ কোথায় কোথায় প্রচারে আছে ছড়ি প্রশ্নে– তিনি বলেন, ‘ঢাকা-৮, ঢাকা-৫ সহ সব জায়গাতেই আমরা আছি। কয়েকটিতে জিততেও পারি।’ প্রচারে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে কিনা– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা চাইতে যাইনি। যারা গিয়েছিল, তারা এখন কান্নাকাটি করছে। আসন পায়নি, ভোটের প্রচারে তারা এখন টাকাপয়সাও পাচ্ছে না।’

ঢাকা-৮ আসনে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তাঁর বিরুদ্ধে আট প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে কারও প্রচার দেখা যায়নি। নাছিমের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। একই অবস্থা ঢাকা-১৩ আসনে। সেখানে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হননি। বাকি পাঁচ প্রার্থীর সবাই নামসর্বস্ব দলের। কারও প্রচারসামগ্রী খুঁজে পাওয়া গেল না মাঠে।

রাজধানীর ১১টি আসনে ‘টেলিভিশন’ প্রতীকে প্রার্থী দেওয়া বিএনএফ ঢাকা-১৩ আসনেও প্রার্থী দিয়েছে। টেলিভিশনের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কালামের সঙ্গে কথা না হলেও দলের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেছেন, জোরেশোরে প্রচার চলছে। শুক্রবার ঢাকা-৯ আসনে সফল গণসংযোগ করা হয়েছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসন থেকে এমপি হয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। এবার তিনি ঢাকা-১৭ ও ঢাকা-১৮ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। আবুল কালাম আজাদের ভাষ্য, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে বাইরে রাখা হয়েছিল। এবার জয়ের জন্যই লড়ছেন।

ঢাকা-১৪ আসনে সর্বোচ্চ পাঁচজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নৌকার বিরুদ্ধে ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন। গাবতলী, কলেজ গেট এলাকায় নৌকার সমানে সমান তাঁর প্রচারসামগ্রী দেখা যায়।

ঢাকা-১৪ আসনের বিএনপির সাবেক এমপি এস এ খালেকের বাড়ির সামনে চায়ের দোকানে গতকাল বিকেলে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। ছয়জনের মধ্যে দু’জনকে পাওয়া গেল, যারা ওই আসনের ভোটার। তাদের একজন বাস কাউন্টারে চাকরি করা এনামুল হক বললেন, বিএনপি ভোটে না থাকায় নির্বাচনের মজা নেই। নৌকা ও ট্রাকের মধ্যে যতই লড়াই চলুক, ঘুরেফিরে সবাই আওয়ামী লীগ। বাকি দলগুলোর প্রার্থীকে চেনেন না। তারা আওয়ামী লীগকে হারাতে নয়, প্রার্থী বাড়াতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বলে ধারণা এনামুলের।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button