ইউনূসের মামলা কতটা শাস্তিযোগ্য?
- সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড
- ইউনূসের মামলা যতটা না শাস্তিযোগ্য তার চেয়ে বেশি প্রোপাগান্ডা
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শ্রম আইনের মামলা যতটা না ভয়াবহ বা শাস্তিযোগ্য তার চেয়ে ঢের বেশি প্রোপাগান্ডা। এ মামলার রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে তার সাজার খবর রটবে।
ড. ইউনূসের পক্ষে তদবির করেছেন বিশ্বের তাবৎ সেলিব্রেটিরা। তারা স্টেটমেন্ট দিয়ে মামলার নামে তাকে হয়রানি না করার অনুরোধ করেছেন। তিনি নিজে নতি স্বীকার করেছেন। আদালতে বলেছেন ‘আমিতো মানুষ। আমারও ভুল হতে পারে।’ এমনকি ইউনূস এ মামলা হওয়ার পর দাবিকৃত কিছু অর্থও পরিশোধ করেছেন। এ অবস্থায় দেখার বিষয় শ্রম আদালত মামলার কী রায় দেয়।
শ্রম আইনের যেসব ধারায় মামলা করা হয়েছে সেখানে শাস্তির পরিমাণ খুব বেশি নয়। তা ছাড়া মামলাটির পদ্ধতিগত ত্রুটিও রয়েছে। শ্রম আইনের ৪, ১১৭ ও ২৩৪ এই তিন ধারায় মামলা হয়েছে। ভুল তথ্য দেওয়ার কারণে পরিদর্শকরা শাস্তি চেয়েছেন ৩০৩ (ঙ) এবং ৩০৭ ধারায়।
ধারা ৪ চাকরি স্থায়ী না করা সংক্রান্ত। ১১৭ হচ্ছে অর্জিত ছুটি না দেওয়ার। আর ২৩৪ হচ্ছে লভ্যাংশ না দেওয়ার। ৪ ও ১১৭ ধারা না মানার শাস্তি হয় ৩০৭ অনুযায়ী। এই ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি ২৫ হাজার টাকা। আর তথ্য না দেওয়ার কারণে এবং মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কারণে ৩০৩ ধারায় শাস্তির বিধান আছে। এ ধারায় শাস্তি ছয় মাসের জেল এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা। ৩০৩ (ঙ) এর সাজা হচ্ছে ৬ মাসের জেল।
ড. ইউনূসের সঙ্গে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শকদের মূল বার্গেনিং ইস্যু হচ্ছে লভ্যাংশ দেওয়ার জন্য ফান্ড গঠন করা হয়নি। ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করা হয়নি। নিয়োগপত্রও দেয়নি। শ্রমিকদের অংশগ্রহণের তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।
জটিলতা হচ্ছে ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম নিয়ে। গ্রামীণ টেলিকম যেসব ব্যবসায়িক কাজ পরিচালনা করে সেগুলো চুক্তিভিত্তিক। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তা নবায়নের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। গ্রামীণ টেলিকমের প্রকল্প নোকিয়া কেয়ার ও পল্লীফোনের কার্যক্রম তিন বছরের চুক্তি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। মেয়াদ শেষে তা নবায়ন হয়। গ্রামীণ টেলিকমের কার্যক্রম চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এর লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়। ফলে মূল লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিলে দেওয়ার সুযোগ নেই দাবি গ্রামীণের। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারী ইউনিয়ন ওই অর্থ পাওয়ার আশায় শ্রম আদালতে মামলা করে।
শ্রম আইনে শাস্তির বিধান আছে ১৯ অধ্যায়ে। এ আইনে মামলা করার এখতিয়ার সরকারের। সরকার বলতে বোঝানো হয় মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু এখনে মামলা করেছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শকরা। বিষয়টি আদালতে তুলে ধরেছেন টেলিকমের কৌঁসুলিরা। এটাকে আদালত কীভাবে নেবে সেটা কৌতূহলের বিষয়। আদালত ইচ্ছা করলে বিষয়টাকে পরিদর্শকের এখতিয়ার বহির্ভূত হিসেবেও নিতে পারেন।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখানে সরকারই গ্রামীণ টেলিকমকে জরিমানা করতে পারত। এর জন্য আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। এর জন্য মামলা করার কোনো দরকার ছিল না। সরকার জরিমানার আদেশ জারি করলে তা না মানলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারত। নিয়োগপত্র না দেওয়ার ব্যাখ্যাও আছে।
নিয়োগপত্র না দিলেও তাদের বেতনভাতা দেওয়া হয়েছে। তবে শ্রমিকের লভ্যাংশ মাফ করার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছেন তাদের প্রতিষ্ঠান অলাভজনক। তাই লভ্যাংশের কোনো প্রশ্ন এখানে আসতে পারে না। তারপরও ড. ইাউনূস ইতিমধ্যে ৪১৭ কোটি টাকা লভ্যাংশ দিয়ে দিয়েছেন। ড. ইউনূস ফান্ড গঠন করে টাকা দিয়ে দিয়েছেন। যদিও মামলাটি হয়েছিল এসব অর্থ পরিশোধের আগে। এটাকেও অন্যান্য অপরাধ ধরলে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
শ্রম আইনের ১৯ অধ্যায়ে বিভিন্ন অপরাধের জন্য বিভিন্ন শাস্তির কথা বলা আছে। অন্যান্য অপরাধের শাস্তি ৩০৭ ধারায়। আইনে যে শাস্তি চিহ্নিত করা নাই সেই শাস্তি হচ্ছে সর্বোচ্চ শাস্তি ২৫ হাজার টাকা। নিয়োগ পত্রের জন্য হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ২৫ হাজার টাকা। আগামী বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চুক্তিভিত্তিক কাজ করায় কোম্পানি অস্থায়ী হবে এমন বিধান কোম্পানি আইনে বলা নেই। বরং কোম্পানি আইনে কোম্পানি বলতে যা দেউলিয়া না হওয়া পর্যন্ত বা আজীবন থাকবে। তিন বছর পর পর চুক্তিতে কাজ নেওয়া হয় তার অর্থ এই নয় যে শ্রমিকের চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক হবে! তাহলে গার্মেন্ট মালিকরা যখন ইউরোপ-আমেরিকা হতে তিন-চার মাসের কোনো একটা কাজের আদেশ পান সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্থায়ী সুবিধা দেবেন না। বেশির ভাগ উৎপাদন বা সেবা প্রতিষ্ঠান বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। তাই বলে শ্রমিক ক্যাজুয়াল বা অস্থায়ী নয়। আর অস্থায়ী শ্রমিকও যদি ৯ মাস চাকরি করে তাহলে তিনি লভ্যাংশ পাওয়ার অধিকারী। শ্রম আইনের সব সুযোগ-সুবিধা শ্রমিক বা কর্মীরা পাবেন।
ইউনূসের প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা বা উদ্যোক্তা লাভ নেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন । কিন্তু দরিদ্র শ্রমিক, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কোম্পানি লাভজনক হলো, তা থেকে তাদের কেন বঞ্চিত করা হবে। তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের স্লোগান দিয়ে নিজ কর্মীদের দারিদ্র্যয় লালন করতে চেয়েছেন বলে মনে করা অন্যায় নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
নোবেল পুরস্কার লাভ করার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠন করার উদ্যোগ নিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। ফখরুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার আগে তাকে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ভারত সফরে যান। সে সফরে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জোরালো সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। ২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে বৈঠক করেন ইউনূস। ৩১ জানুয়ারি দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউনূস বলেছিলেন, দেশের পরিস্থিতি বাধ্য করলে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন।
জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে ইউনূস বিভিন্ন সময় দেশের প্রচলিত রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের কড়া সমালোচনা করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার দলের সম্ভাব্য নাম নাগরিক শক্তি।
রাজনীতিতে আসার জন্য তিনি জনগণের উদ্দেশে যে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন তার তিন মাসের মধ্যেই সে প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন। ইউনূস যখন রাজনীতিতে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেন তখন সেটির কড়া সমালোচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।