রাজনৈতিক অস্থিরতায় আগেই যাচ্ছে ব্যালট
দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্গম এলাকা বিবেচনায় স্বাভাবিক সময়ের আগেই ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী জেলাগুলোতে পাঠানোর কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল সোমবার ১৩ জেলায় ব্যালট পেপার বিতরণ করেছে ইসি। ৩১ ডিসেম্বরের আগেই সব জেলায় ব্যালট পৌঁছানোর কাজ শেষ করতে চায় সংস্থাটি। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০টি আসনে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া বা বাতিল নিয়ে মামলা থাকায় সবশেষে এ ব্যালট ছাপানোর ও বিতরণ করা হবে।
ইসির সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ ২৭টি দল নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত থাকলেও বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ভোট বর্জনের আহ্বানে অসহযোগের ডাক দিয়েছে। গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকেই দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ দিচ্ছে তারা। এসব কর্মসূচির মধ্যে যানবাহনে নাকশতার ঘটনাও ঘটছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকায় জেলায় জেলায় নির্বাচনী সামগ্রী পাঠাতে ঝুঁকি দেখছেন নির্বাচনসংশ্লিষ্টরা। ফলে ভোটের দুই সপ্তাহ বাকি থাকতেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট পেপার ঢাকা থেকে জেলা পর্যায়ে পাঠানো শুরু করেছে। ইসির দায়িত্বপ্রাপ্তদের ধারণা, নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে বিরোধী দলগুলোর কর্মকা- আরও বাড়বে। এতে দুর্গম এলাকাগুলোতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যালট পৌঁছানোর ঝুঁকি থেকে যাবে। ঝুঁকি নিতে চায়নি বলেই এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছিলেন, ২৫ তারিখের পর থেকে তারা জেলা পর্যায়ে ব্যালট পাঠানো শুরু করবেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘দুর্গম এলাকায় ব্যালট আগেই যাবে। সেটি ইসি জানিয়েছিল। কিন্তু এত আগে কেন যাচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। সেটি না হলে বিভ্রান্তি থেকে যাবে।’
ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছেন, ভোটের দিন জেলা থেকে সব উপজেলায় ব্যালট পাঠানো সম্ভব হবে না। কারণ ভোটের আগের দিন কেন্দ্র অনুযায়ী ব্যালট সেট করতে হবে, বাছাই করতে হবে। সেগুলো আগেই পৌঁছাতে হবে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সংসদ নির্বাচনে মহানগর, জেলা ও উপজেলা সদরসহ অধিকাংশ এলাকায় ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার পাঠানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে ইসির। দুর্গম পার্বত্য এলাকা, হাওর, চরাঞ্চলসহ জেলা-উপজেলা-মহানগর থেকে বেশি দূরের যেসব কেন্দ্রে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানো সম্ভব নয়, সেসব কেন্দ্রের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আরও জানান, প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া বা বাতিল নিয়ে মামলাগুলো মাথায় রেখে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যালট মুদ্রণ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।
তবে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শাহজালাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় কোনো ঝুঁকি দেখছেন না তারা। দূরত্ব বিবেচনা করেই ব্যালট পেপার এবার দ্রুত বিতরণ শুরু করেছে ইসি।
জানা গেছে, গতকাল সোমবার ঢাকার তিনটি প্রেস থেকে প্রথম ধাপে ১৩টি জেলার ৫২টি আসনের জন্য ব্যালট পেপার, পোস্টাল ব্যালট পেপার, পোস্টাল ব্যালট পেপারের সঙ্গে সম্পর্কিত ফরম এবং স্ট্যাম্প প্যাড পাঠানো হয়েছে। ঢাকা থেকে বাকি জেলাগুলোতে ব্যালট পেপার পাঠানোর কাজ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করতে চায় ইসি। ব্যালটগুলো পাঠানোর পর জেলা প্রশাসকের ট্রেজারিতে পুলিশি নিরাপত্তায় থাকবে। পরে ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হবে। প্রথম দিন ঢাকার গভর্নমেন্ট প্রিন্টিং প্রেস থেকে পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও রাঙ্গামাটি; বিজি প্রেস থেকে জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝালকাঠি ও ভোলা এবং সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে বরগুনা, পটুয়াখালী ও নেত্রকোনা জেলার ব্যালট পেপার বিতরণ করা হয়।
মো. শাহজালাল আরও জানান, সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তা এবং পুলিশ সঙ্গে এসে এসব সামগ্রী নিয়ে গেছে। নিরাপত্তার জন্য মোবাইল টিমগুলোও থাকছে।
ইসির সূত্র বলছে, ভোটের জন্য আসনভিত্তিক ভোটার সংখ্যার সমান ব্যালট পেপার ছাপাতে হয়, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নাম ও প্রতীক থাকে। নির্বাচন কমিশন আসনভিত্তিক ভোটার তালিকাও প্রকাশ করেছে নভেম্বরে (গেজেটে সংখ্যা কয়েকজন কমবেশি হতে পারে)। সেই অনুযায়ী, দেশে মোট ভোটার এখন ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। তাদের মধ্যে ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন পুরুষ; ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন নারী এবং ৮৫২ জন হিজড়া। সারা দেশে প্রার্থী আছেন ১ হাজার ৮৯৪ জন।
জানা গেছে, এর আগে যেসব জেলায় ব্যালট পাঠানো হবে তাদের ব্যালট পেপারের বিতরণের তারিখ ও স্থান উল্লেখ করে নির্বাচনী সামগ্রী সরবরাহের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইসি নির্দেশনা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রিটার্নিং কর্মকর্তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত উপযুক্ত প্রতিনিধিকে (জেলা নির্বাচন অফিসার, সহকারী কমিশনার) প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট ছাপাখানা থেকে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করতে হবে। নির্বাচনী এলাকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নাম ও প্রতীক এবং ভোটার সংখ্যা যাচাই করে ব্যালট পেপার প্রতিনিধির হাতে তুলে দেওয়া হবে। ছাপাখানা থেকে ব্যালট পেপার ও পোস্টাল ব্যালট বুঝে নেওয়ার আগে নির্বাচন ভবনের গোডাউন থেকে স্ট্যাম্প প্যাড সংগ্রহ করতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, ব্যালট পেপার, পোস্টাল ব্যালট পেপার, পোস্টাল ব্যালট পেপারের সঙ্গে সম্পর্কিত ফরম এবং স্ট্যাম্প প্যাড জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ট্রেজারি শাখায় সংরক্ষণসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব সামগ্রী সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে পৌঁছানোর পর ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো অসংগতি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এবার ৩০০ সংসদীয় আসনে যত ভোটার তত সংখ্যা ব্যালট ছাপা হবে। সবচেয়ে বেশি ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৬ ভোটার রয়েছে গাজীপুর-২ আসনে। আর সবচেয়ে কম ভোটার ঝালকাঠি-১ আসনে ২ লাখ ১২ হাজার ১২ জন। ঢাকা জেলার ২০টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটার ঢাকা-১৯ আসনে ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪১৯ জন। এর আগে ২০১৮ সালে এ আসনে দেশের সর্বোচ্চ ভোটার ছিল। গেল নভেম্বরের শুরুতে আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা করার কাজ শেষ হয়। এরপর ৩০০ আসনের ভোটকেন্দ্রের গেজেটও প্রকাশ করা হয়েছিল।