নির্বাচনে ‘নির্দিষ্ট’ কিছু প্রার্থীকে জেতানোর তৎপরতায় সরকার–ঘনিষ্ঠ মহল
নৌকার প্রার্থীর বাইরে নির্দিষ্ট কিছু প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনো কোনো মহল তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নামানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও চাপ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে অন্তত ১৫টি আসনে এমন তৎপরতার তথ্য পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও নীতিনির্ধারকদের কথা বলে কোনো কোনো মহল যাঁদের জিতিয়ে আনার জন্য এই তৎপরতা চালাচ্ছে, তাঁরা কেউ আওয়ামী লীগের দলীয় কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী নন। তাঁদের বেশির ভাগই এক সময় বিএনপিতে ছিলেন। কেউ কেউ ‘কিংস পার্টি’ বলে পরিচিত বিভিন্ন দলের হয়ে নির্বাচন করছেন। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় এলাকা থেকে এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও বলছে, কোনো কোনো মহলের এই তৎপরতার বিষয়টি আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদেরও অজানা নয়। তবে আলোচিত এসব প্রার্থীর কারও কারও অবস্থান এতই নাজুক যে জিতিয়ে আনা বেশ কঠিন। কিছু আসনে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দলীয় প্রার্থী রয়েছেন। ফলে কিছু জায়গায় এই তৎপরতার লাগাম টানার চেষ্টাও আছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের।
জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলেও ৩-৪টি আসনে জাপার প্রার্থীর পক্ষে থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ নজরে থাকা প্রার্থীরা
যেসব প্রার্থীর সমর্থনে সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের তৎপরতা রয়েছে, এমন প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন তৃণমূল বিএনপির শমসের মুবিন চৌধুরী ও বিএনএমের শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। বগুড়ার চার স্বতন্ত্র—প্রার্থী বিএনপি থেকে ছেড়ে আসা জিয়াউল হক মোল্লা রয়েছেন। বিএনপি থেকে বহিস্কৃত নেতা সরকার বাদল, বিউটি বেগম ও মো. শোকরানা রয়েছেন। কিশোরগঞ্জে বিএনপির বহিস্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান ও কক্সবাজারে কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম আছেন এই তালিকায়। আরও রয়েছেন জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী তিন নেতা—রংপুরে মসিউর রহমান (রাঙ্গা), পিরোজপুরে রুস্তম আলী ফরাজি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জিয়াউল হক মৃধা।
সিলেটে ফুলতলীর পীর হুছামুদ্দীন চৌধুরী, সুনামগঞ্জে তৃণমূল বিএনপি থেকে নির্বাচন করা সাবেক জমিয়ত নেতা শাহীনূর পাশা চৌধুরীও সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের নজর পাওয়ার আলোচনায় আছেন। চট্টগ্রামে সুপ্রিম পার্টির সৈয়দ সাইফুদ্দিন মাইজভান্ডারির পক্ষেও তৎপরতা রয়েছে। তবে এই তৎপরতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদেরও কেউ কেউ যুক্ত।
দলীয় সূত্র বলছে, নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বার্তা পেয়েই নিজাম হাজারী লাঙ্গলের পক্ষে নেমেছেন।
সমঝোতার আসনেও বিশেষ নজর
আওয়ামী লীগ শরিক ও মিত্রদের যে আসনগুলো ছেড়েছে, সেগুলোর মধ্যেও নির্দিষ্ট কিছু আসনে দলটির রাজনৈতিক দিক থেকে এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের তৎপরতা রয়েছে।
জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলেও ৩-৪টি আসনে জাপার প্রার্থীর পক্ষে থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম-৫ আসনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে জেতাতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা নেমেছেন। সর্বশেষ আলোচনায় এসেছেন ফেনী-২ আসনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। তাঁর পক্ষে ফেনী-৩ আসনের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন হাজারীও নেমেছেন। দলীয় সূত্র বলছে, নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বার্তা পেয়েই নিজাম হাজারী লাঙ্গলের পক্ষে নেমেছেন।
রওশন এরশাদপন্থী তিন প্রার্থীকে জেতাতেও তাঁদের সমর্থনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের মাঠে নামানো হয়েছে।
১৪ দলের শরিকদের ছয়টি আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নৌকা প্রতীকে ভোট করছেন। কিন্তু প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ জন্য ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জাতীয় পার্টি (জেপি) শীর্ষ নেতাদের জিতিয়ে আনার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কাছে বাড়তি তৎপরতা আশা করছে।
জাফরের সমর্থকদের দাবি, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী জাফরের পক্ষে আছেন, তাঁরা এখন কোণঠাসা, অনেকে এলাকাছাড়া।
যেভাবে প্রার্থীদের পক্ষে তৎপরতা
চট্টগ্রাম-২ আসনে টানা দুবার নৌকা নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন ১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। কিন্তু এবার সমঝোতায় আসনটি ভাগে পাননি। আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দেয় প্রয়াত সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ারকে। নজিবুল বশর নিজ দলের প্রতীক ফুলের মালা নিয়ে ভোট করছেন। আরও প্রার্থী হয়েছেন ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ মাইজভান্ডারী। তিনি নজিবুল বশরের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা এইচ এ তৈয়ব।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, নজিবুল বশরের বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে। এ জন্য ভান্ডারী দরবার শরিফের আরেক প্রতিনিধি সৈয়দ সাইফুদ্দিনের প্রতি সুনজর দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গত ২৭ ডিসেম্বর সৈয়দ সাইফুদ্দিন ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। পরদিন দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সাইফুদ্দিনের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান বলেন, প্রথমে সাইফুদ্দিনের পক্ষে কাজ করার একটা বার্তা এসেছিল। এখন তাঁরা নৌকার পক্ষে মাঠে রয়েছেন। তবে সুপ্রিম পার্টির সাইফুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আশ্বাস পেয়েছিলেন। পরে কী হয়েছে জানা নেই। তবে তিনি ভোটে আছেন।
গত ২৭ নভেম্বর সিলেট-৫ আসনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমেদকে এবং সিলেট-৬ আসনে সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। প্রচার শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষ ত্যাগ করার চাপ দেওয়া শুরু হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। এরপর দলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। নুরুল ইসলাম নাহিদের আসনে নির্বাচন করছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরী। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একটা অংশ এখন তাঁর পক্ষে মাঠে।
এই পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে ঢাকায় এসে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। শমসের মুবিন চৌধুরীরও ঢাকায় বৈঠকের খবর পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নুরুল ইসলাম নাহিদকে ভোটে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে শমসের মুবিনের পক্ষে নানা জায়গা থেকে তৎপরতা থাকায় নুরুল ইসলাম নাহিদ কতটা কুলিয়ে উঠতে পারবেন, এই আলোচনা চলছে।
সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনে ফুলতলী পীরের অনুসারীদের একটা প্রভাব সব সময়ই থাকে। এই আসনে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী। তাঁর বাবা প্রয়াত আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী সারা দেশে ‘ফুলতলী হুজুর’ হিসেবে পরিচিত।
তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাসুক উদ্দিনের জন্য স্বতন্ত্র হুছাম বড় হুমকি হবেন না বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একটা অংশ নিজ পক্ষ ত্যাগ করে হুছামুদ্দীনের পক্ষে ভিড়ছেন। এর পেছনে ‘ওপর’ থেকে চাপ আছে বলে আলোচনা রয়েছে।
কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালাহ উদ্দিনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এরপরও স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম মাঠে ছিলেন। কিন্তু এই আসনে বিএনপির জোট থেকে বের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া কল্যাণ পার্টির নেতা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে জেতানোর তৎপরতা আছে। জাফরের সমর্থকদের দাবি, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী জাফরের পক্ষে আছেন, তাঁরা এখন কোণঠাসা, অনেকে এলাকাছাড়া।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির বহিস্কৃত সাবেক সেনা কর্মকর্তা আখতারুজ্জামানের পক্ষে নেমেছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ। দলীয় প্রার্থী আবদুল কাহার আকন্দ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সোহরাব উদ্দিন থাকার পরও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ আখতারুজ্জামানের পক্ষে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, নেতা-কর্মীদের নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার চাপ দেওয়ার বিষয়টি সত্য। তবে এখন বন্ধ আছে।
বগুড়ার তিনটি আসনে বিএনপি ছেড়ে আসা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে চাপ আছে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে। সুনামগঞ্জে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাবেক নেতা শাহীনূর পাশা চৌধুরী সুনামগঞ্জ-৩ আসনে তাঁকে জয়ী করার নির্দেশনা আছে বলে প্রচার করছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে বিএনপি ছেড়ে আসা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামানের পক্ষেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ নেমেছে। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য বি এম ফরহাদ হোসেন। তাঁর সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই সুযোগে এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছয়জন একরামুজ্জামানের পক্ষ নিয়েছেন। একরামকে সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীও।
আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ একজন নেতা বলেন, বিএনপিবিহীন নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে অনেককে জেতানোর আশ্বাস দিয়ে ভোটে আনা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী সংসদে যাতে ডান, বাম, মধ্যপন্থী, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থীদের একটা মিশ্রণ থাকে, সেই চেষ্টাও আছে আওয়ামী লীগের। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আগামী সরকার গঠন করবে—এ ব্যাপারে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। ফলে যতটা সম্ভব ‘পছন্দের’ প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার চেষ্টা রয়েছে।