Bangladesh

২৭ দলের শোচনীয় পরাজয়

২২টি দলের প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ২৩ দলের কোনো প্রার্থী জিততে পারেনি :: জামানত হারিয়েছে জাতীয় পার্টির ২৫০ প্রার্থী :: দ্বাদশ সংসদে থাকছে মাত্র ৫টি দলের প্রতিনিধিত্ব :: ফলাফলে প্রমাণ করে এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা নির্বাচন -বদিউল আলম মজুমদার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের সাথে যেসব রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে তারা সবাই গো-হারা হেরেছে। বলা যায় যে, আওয়ামী লীগের সাথে অন্য কোনো দলের প্রার্থীর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে এবারও আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া যে ২৭টি দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল তাদের সবারই শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। এই ২৭টি দলের মধ্যে ২২টি রাজনৈতিক দল কোনো আসনে জয়ী হতে পারেনি। তাদের প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যে ৪টি দল ১৪টি আসনে বিজয়ী হয়েছে সেগুলোও আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে ১৪ দলের শরিকরা এবং জাতীয় পার্টি যে ৩২টি আসন পেয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ১১টিতে তারা জয়ী হয়েছে।

১৪ দলের শরিকরা যে ৬টি আসনে নির্বাচন করেছে সেগুলোতে তারা নিজের দলের প্রতীক বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তারপরও তাদের অনেকের শেষ রক্ষা হয়নি। নৌকায় উঠেও নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে পারেননি। এ ৬টি আসনের মধ্যে তারা ৪টিতে পরাজিত হয়েছেন। এর মধ্যে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার মতো হেভিওয়েট প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। অন্যদিকে কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির সব প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনের প্রাপ্ত বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী জাতীয় পার্টির (জাপা) ২৫০ জন প্রার্থীও জামানত হারিয়েছেন। জাপার যে ১১ জন বিজয়ী হয়েছেন তার সবগুলোই আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেয়া ২৬ আসনের মধ্যে। আওয়ামী লীগ করুণা করেনি এমন কোনো আসনে দলটির কোনো প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি।

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এদেশের রাজনীতি স্বৈরশাসন থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে। এরপর ১৯৯১ সালে গঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদে ১৩টি দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এরপর ষষ্ঠ সংসদ বাদে সব সংসদেই প্রতিনিধিত্ব ছিল ছয় থেকে নয়টি দলের। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ২৩ দলের কোনো প্রার্থী ভোটে জিততে পারেননি। ফলে বর্তমান দ্বাদশ সংসদে সবচেয়ে কম মাত্র পাঁচটি দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

নির্বাচনের এই ফলাফল বিবেচনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ নির্বাচনকে একতরফা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বলে উল্লেখ করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, এ নির্বাচনের ফলাফলই প্রমাণ করে যে, এটা প্রতিদ্ব›িন্দ্বতাহীন একতরফা একটি সাজানো নির্বাচন হয়েছে। এ নির্বাচনে যেসব দল অংশ নিয়েছে তার সব দলের প্রার্থীই জামানত হারিয়েছে। যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে সেখানে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের দলেরই স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানো ডামি প্রার্থীর। সেসব আসনের কোথাও আওয়ামী লীগের নৌকা জয়ী হয়েছে কোথাও বা তাদের স্বতন্ত্র ডামি প্রার্থী জয়ী হয়েছে। তাই এ নির্বচনটা একেবারেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা নির্বাচন হয়েছে। আর এ জন্যই নির্বাচনের প্রতি সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না। তাইতো নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিও ছিল খুবই কম।

এর আগে জাপা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাপাকে ৩৩টি আসন দেওয়া হয়েছিল। সেবার তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে মন্ত্রিসভায় থাকে, আবার বিরোধী দলেরও ভূমিকা পালন করে। তখন থেকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে তারা আখ্যায়িত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে জাপা ২৩টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল হয়। এবার দলটি গতবারের অর্ধেকের কম আসন পেল। এবার সমঝোতার ২৬টি আসনের মধ্যে মাত্র ১১টিতে জয়ী হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার জয়ী হয়েছেন। চরম বার্গেনিং করে আওয়ামী লীগ থেকে নেয়া ঢাকার একমাত্র আসনে (ঢাকা-১৮) চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য শেরীফা কাদের জামানত হারিয়েছেন। তিনি হেরেছেন আওয়ামী লীগের অলিখিত প্রার্থী খসরু চৌধুরীর কাছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করায় আজকের দলের এই ভরাডুবি।

তবে দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের তা মনে করেন না। দল হিসেবে জাতীয় পার্টির সক্ষমতা এখনো আছে বলে তিনি মনে করেন। পরাজয়ের কারণ হিসেবে তিনি এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তাদের ওপর সেই আস্থা রেখেই আমরা নির্বাচনে গিয়েছি, কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেনি। এরকম করলে তো যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। সার্বিকভাবে দেশের নির্বাচন ভালো হয়নি। আমরা এটি আশঙ্কা করেছিলাম। সরকার যেখানে চেয়েছে নির্বাচন নিরপেক্ষ করেছে, আবার যেখানে চেয়েছে তাদের প্রার্থীকে জিতিয়েছে। তাই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ কারণে নির্বাচনে কেউ আসতেও চায়নি। আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না তা আমি বলতে পারছি না। তবে আমার মূল্যায়নে সরকারের নিয়ন্ত্রিত এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কথা না।

জাতীয় পার্টির মতো আরো অনেক দল ও নেতা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে নির্বাচনে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কিংস পার্টির নেতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া শমসের মুবিন চৌধুরী, তৈমূর আলম খন্দকার, শাহ আবু জাফর তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। তাদের দলের নেতাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৯০ ভোট। আর চেয়ারম্যন শমসের মোবিন পেয়েছেন ১০ হাজার ভোট। অপর কিংস পার্টি সুপ্রিম পার্টিরও সব প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। পার্টির চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভাণ্ডারী পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৩৮ ভোট। কিংস পার্টির মধ্যে শুধু কল্যাণ পার্টি নেতা মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহীম (বীর প্রতীক) বিজয়ী হয়েছেন। তবে তাকে সরকার বিজয়ী করেছে এমন আলোচনা রয়েছে। তার পক্ষে বিশেষ সংস্থা কাজ করেছে বলে ইসিতে অভিযোগ দাখিল হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানও কিশোরগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করে জামানত হারিয়েছেন। ২০১৮ সালে বিএনপির সমর্থন নিয়ে বিজয়ী হয়েছিল গণফোরামের নেতা অ্যাডভোকেট মোকাব্বির খান। তিনি এবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি, সঙ্গীত শিল্পী ডলি সায়ন্তনীও পরাজিত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৪ সালে গঠিত হয় ১৪ দলীয় জোট। এই জোটকে আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ঐক্যের বন্ধনে থাকা ১৪ দলীয় জোটকে এবার মাত্র ৬টি আসনে নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। ১৪ দলীয় জোটের নেতারা যদিও আরো অনেক বেশি আসন দাবি করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার সময় জোটের শরিক দলের নেতাদের তিনি স্পষ্ট বলেছেন আপনারা এতদিন আমাদের সঙ্গে ক্ষমতায় আছেন কিন্তু নিজেদের দলকে শক্তিশালী করেননি কেন? আপনারা নিজেদের দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলে কোথাও জয়লাভ করতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর এমন সত্য কথায় জোটের নেতারা সব একেবারে চুপসে যায়। অনেক কাকুতি-মিনতি করে শেষ পর্যন্ত ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা মাত্র ৬টি আসন ভাগে পায়। তবে এবার আওয়ামী লীগ এসব আসনেও অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেন। এর ফলে ৬টি আসনের মধ্যে চারটিতেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরে গেছেন ১৪ দলীয় জোটের শরিকেরা। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা ও জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। এরা দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগকে সহায়তা দিয়ে আসছিল। ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের চাওয়া ছিল ভাগে পাওয়া আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগ শরিকদের সেই দাবি আমলে নেয়নি। ফলে ভাগে পাওয়া ছয়টি আসনে জেতার বিষয়ে অনেকটাই অনিশ্চয়তায় ছিলেন শরিক দলের প্রার্থীরা। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে হেরে তাদের সে আশঙ্কাই সত্য হলো।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button