Bangladesh

ভয়েস অব আমেরিকার রিপোর্ট: শেখ হাসিনার ক্ষমতায় ফেরাকে ভারত কেন স্বাগত জানায়?

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসা ভারতের জন্য ভালো হয়েছে। বিশ্লেষকরা এমনটিই বলছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন অবশ্য বলেছে— দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে হাসিনার শাসনকে প্রসারিত করা সাম্প্রতিক নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না। কিন্তু নয়াদিল্লি তাকে প্রতিবেশী অঞ্চলে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে যেখানে তার সামরিক বাহিনীকে পাকিস্তান ও চীন উভয়ের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ এবং বিতর্কিত সীমানায় মুখোমুখি হতে হয়।

নয়াদিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অধ্যয়ন ও পররাষ্ট্রনীতির ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ ভি. পান্তের মতে, সে জন্যই বাংলাদেশে (যার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ স্থলসীমান্ত রয়েছে) বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার ভারতের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পন্ত বলেন, ‘হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক অস্থিরতার সম্মুখীন হয়েছিল ভারত। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে তিনি অবিচল এক মিত্র ছিলেন। চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির মতো বহু ব্যথার মুখোমুখি ভারত খুবই চ্যালেঞ্জিং প্রতিবেশী অঞ্চলে বাস করার পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত যে তাকে ক্ষমতায় অব্যাহত রাখতে চায় এটিই স্বাভাবিক।’

টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অন্যদের মধ্যে প্রথম শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (আগের টুইটারে) লিখেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের স্থায়ী এবং জনকেন্দ্রিক অংশীদারত্বকে আরও জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ অন্যদিকে হাসিনা নিজের বিজয়ের পর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভারতকে ‘মহান এক বন্ধু’ বলে অভিহিত করেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের জন্য সর্বাধিক অগ্রাধিকার হলো তার কৌশলগত স্বার্থ। তারা জানান, হাসিনা ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখেছেন। বেইজিং নিজের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোতে নিজের পায়ের ছাপ উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করেছে।

২০১৬ সালে ঢাকা বেইজিংয়ের বিআরআইতে যোগদান করে। চীন বাংলাদেশে সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রেল প্রকল্পসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করছে। চীন বাংলাদেশের সামরিক হার্ডওয়্যারেরও প্রধান সরবরাহকারী।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডিন শ্রীকান্ত কোন্ডাপল্লির মতে, ‘কিছু প্রকল্প যেগুলোর দুই ধরনের ব্যবহার রয়েছে, সেগুলো নতুন দিল্লিতে প্রশ্ন তুলেছে।

বেইজিং বাংলাদেশে সাবমেরিন ঘাঁটি তৈরি করছে এবং ঢাকায় দুটি সাবমেরিনও সরবরাহ করেছে। তাদের মধ্যে যে কোনো ধরনের সামরিক সহযোগিতা উদ্বেগের বিষয় হবে।’

যাই হোক, তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ ‘চীনের সঙ্গে নিজের অংশীদারত্বকে একটি উন্নয়নমূলক অংশীদারত্ব হিসেবে বর্ণনা করে এবং সাধারণত দেশটি ভারতীয় সংবেদনশীলতার প্রতি সচেতন ছিল।’
সাবমেরিন ঘাঁটিটি হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে, যেটি ভারত মহাসাগরের একটি মূল জলপথ। সেখানে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনকে আটকাতে একসঙ্গে কাজ করছে।

ঢাকা নয়াদিল্লির উদ্বেগকে প্রশমিত করে বলেছে, চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও প্রাথমিকভাবে সেটি কেবল অর্থনৈতিক সংযোগ কেন্দ্র করেই।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন নির্বাচনের পর ইন্ডিয়া টুডে টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা যে কোনো সাহায্য কিংবা তহবিল গ্রহণের ক্ষেত্রে খুব বিচক্ষণ। তাই জনগণের এমন ভয় পাওয়া উচিত নয় যে বাংলাদেশ চীনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে হাসিনার ধারাবাহিকতা নয়াদিল্লির জন্য স্বস্তির কারণ। সম্প্রতি মালদ্বীপে চীনপন্থি সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে দ্বীপ রাষ্ট্রটির সঙ্গে (ভারতের) সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে।

মণিপাল একাডেমি অফ হায়ার এডুকেশনের ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সংকল্প গুর্জারের মতে, ‘অতীতে শ্রীলংকায় কিংবা বর্তমানে মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশে তেমন কোনো চীনপন্থি, ভারতবিরোধী আলাপ-আলোচনা নেই।’

ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্যও বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা সক্রিয় ছিল। তারা প্রায়শই বাংলাদেশকে অভয়ারণ্য বানাতো যে দেশটির সঙ্গে এমন কয়েকটি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে।

গুর্জারের মতে, ‘হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্যাগুলো লাঘব হয়েছে। কারণ তিনি বাংলাদেশকে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলো দ্বারা ব্যবহৃত হতে দেননি।’

বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করায় হাসিনার বিজয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনের আগে হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। ফলে গণতান্ত্রিক পশ্চাৎপসরণ এবং কর্তৃত্ববাদের উদ্বেগ উত্থাপিত হয়।

এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ‘অন্যান্য পর্যবেক্ষকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে অভিন্ন মতামত পোষণ করে যে, এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না এবং আমরা দুঃখিত যেসব দল এতে অংশগ্রহণ করেনি।’
নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান সত্ত্বেও ভারত পশ্চিমা দেশগুলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আহ্বান জানাচ্ছে।

পন্তের মতে, ‘ভারতকে সূক্ষ্ম এক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। নয়াদিল্লি হাসিনা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বলছে, বাংলাদেশকে একঘরে বা উপেক্ষা করলে তাতে চীন কেবল ওই দেশটিতে বড় এক কেন্দ্রীয় খেলোয়াড়েই পরিণত হবে, যা ভারত বা পশ্চিমা কারও স্বার্থই পূরণ করবে না।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button