Hot

অচল ২৩৫০ কোটির ইভিএম

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আবারও আলোচনায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম। নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। প্রয়োজনীয়সংখ্যক ইভিএম না থাকায় সেটি হয়নি। কিন্তু এখন আবার ব্যালটে ভোটগ্রহণের বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে আগামী স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে এই যন্ত্রে ভোটগ্রহণ করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

দেশে এখন যতগুলো ইভিএম রয়েছে, তার বেশিরভাগই অকেজো হয়ে পড়েছে। এই অচল ইভিএমের সংখ্যা অন্তত এক লাখ। আর এই সংখ্যক ইভিএম কিনতে খরচ হয়েছে ২৩৫০ কোটি টাকার বেশি।

অচল ইভিএমগুলো মেরামত করে আবার ব্যবহার উপযোগী করতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে, তার সংস্থানও আপাতত নেই ইসির হাতে। আবার সরকারও বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এই খাতে নতুন করে কোনো অর্থ বরাদ্দ করার পক্ষে নয়। এ অবস্থায় চলতি বছরের জুনে শেষ হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। ফলে ইভিএমের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশায় রয়েছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি।

২০১৮ সালের ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ইভিএমের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন। ওই সময় দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়। প্রতিটি ইভিএম কিনতে খরচ হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। কয়েক গুণ বেশি দামে কেনা এসব যন্ত্র ১০-১৫ বছর নির্বিঘ্নে ব্যবহার করা যাবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল।

কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, এসব ইভিএমের ৭০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে ইভিএম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছে ১ লাখ ২ হাজার ইভিএম রয়েছে। যার মধ্যে ২০ হাজার ইভিএম ব্যবহার উপযোগী। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে ৪৬ হাজার ইভিএম রয়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ব্যবহার কার যেতে পারে। বাকিগুলোও কমবেশি মেরামত করতে হবে। এ ছাড়া ১০ শতাংশ একেবারেই ব্যবহার অনুপযোগী।

নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস সঠিকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে আরও দেড় হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ইভিএম সরবরাহকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) বলছে, অযত্নে-অবহেলা এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনায় রয়েছে ইভিএম। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে একটি ওয়ার্ডে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দেশে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং গাজীপুরের রাষ্ট্রায়ত্ত মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সহায়তায় এই প্রযুক্তি চালু হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এবং নরসিংদী পৌরসভায় পুরো ভোট হয় ইভিএমে।

পরে কেএম নুরুল হুদা কমিশন ফের ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস করেছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ওই সময় প্রতি ইভিএমের পেছনে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ খরচ হয়েছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনও এখন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে নির্বাচন কমিশন প্রথমে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করার জন্য ২ লাখ ইভিএম মেশিন কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল। কিন্তু একনেকে সেই প্রকল্প অনুমোদন পায়নি। পরে নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা দেড় লাখ পুরনো ইভিএম মেরামতের জন্য সরকারের কাছে ১ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। সরকার সে প্রস্তাবও নাকচ করে দেয়। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালটের মাধ্যমেই করেছে কমিশন।

তবে ইভিএমের এমন পরিস্থিতির জন্য মাঠপর্যায়ের ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন ইভিএম প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ইভিএম মেশিনগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। জেলাপর্যায়ে এসব মেশিন স্যাঁতসেঁতে ও নোংরা জায়গায় সংরক্ষণ করা হয়।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, মাঠপর্যায়ে থাকা কিছু কিছু ইভিএমের ভেতরে পানি, বালু পাওয়া গেছে। আবার কোনোটির কেবল ছেঁড়া, কোনোটি আবার বোতাম নেই। কোথাও পুড়েছে আগুনে। কোনো অঞ্চলে আবার চুরি হয়েছে ইভিএম সেটসহ মনিটর। এ ছাড়া কিছু ইভিএমের মনিটর ভাঙা। উইপোকা ও তেলাপোকার কারণে নষ্ট হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, ‘আমরা অনেকগুলো মেশিন চেক করে দেখেছি। এগুলো চাইলে সহজেই ঠিক করা সম্ভব। কিছু মেশিনের সংযোগ কেবল হলেই আবার কাজে লাগানো যাবে। কোনোটির আবার ডিসপ্লেতে সমস্যা, ভেতরের পার্টস ঠিক আছে। কিন্তু যারা ঠিক করবেন, সেখানে তো কিছু খরচ রয়েছে।’

সর্বশেষ ইভিএম মেশিনের যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল জানুয়ারির ২০ তারিখ। তবে নির্ধারিত সময় পার হলেও এখনো কাজটি সম্পন্ন করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। ইভিএম এখন কোন অবস্থানে আছে, সে বিষয়গুলো নির্ণয় করতে হবে। তারপর কমিশন ব্যবহারযোগ্য মেশিনের সঠিক তথ্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

এ বিষয়ে কর্নেল সৈয়দ রকিবুল হাসান বলেন, ‘কী পরিমাণ ইভিএম ভালো রয়েছে জানতে আমরা কিউসি (যাচাই-বাছাই) করছি। কাজটি চলছে, কিছু কিছু জায়গার রিপোর্ট আমাদের হাতে এসেছে। তাই এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়, কতগুলো ইভিএম ব্যবহার করা যাবে।’

ইভিএমের দুরবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘ওয়্যার হাউজের অভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইভিএম নষ্ট হয়েছে। এখানে ইসির কোনো অবহেলা ছিল না।’

তবে কী পরিমাণ ইভিএম ভালো আছে, সেটা কিউসির ফলাফল পেলে জানা যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি অনেক বেশি মেরামত করার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন। বেশি টাকার প্রয়োজন হলে সেটা তো আমাদের কাছে নেই। প্রজেক্টের বেশি টাকা নেই। সেখানে মাত্র ৬০ কোটি টাকা আছে। তার মধ্য থেকেই করতে হবে। যদি এর বেশি প্রয়োজন হয়, সেটা তো অর্থ মন্ত্রণালয় এখন দেবে না।’

ইভিএম নিয়ে কী পরিকল্পনা কমিশনের, এমন প্রশ্নের জবাবে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, কিউসি করে যতগুলো ভালো পাওয়া যায়, সেগুলোই ব্যবহার করব।

ইভিএম সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে নতুন করে অর্থ চাওয়া হবে কি না জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘কমিশন যদি মনে করে নতুন করে অর্থ চাওয়া প্রয়োজন, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আমার যতটুকু জানা আছে, সরকারের কাছে অর্থ চাইলে দেবে না।’

আগামী মে মাস থেকে ধাপে ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে। এর আগে মার্চে হবে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এসব স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ইভিএম পাওয়া সাপেক্ষে কিছু কিছু জায়গায় ব্যবহারের কথা বলেছে ইসি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button