উত্তর কোরিয়া: সত্যিকারের এক হীরক রাজার দেশ
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘হীরক রাজার দেশ’ সিনেমাটা কমবেশি আমরা সবাই দেখেছি। বহুবার শুনেছি সেই বিখ্যাত ছড়া, ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান।’ তীব্র ব্যঙ্গাত্মক এই সিনেমা দেখে আমরা হেসেছি আর ভেবেছি, এমন রাজা কি আবার হয় কখনো! অথচ আমাদের এই মাটির পৃথিবীতেই যে একটা হীরক রাজার দেশ আছে, যেই দেশে রাজাকে ‘ঈশ্বর’ বলে মেনে নিতে বাধ্য দেশের প্রত্যেক নাগরিক, সেই কথা আমরা কজন জানি?
এশিয়ার সেই দেশের নাম উত্তর কোরিয়া। আর সেই দেশের ‘রাজা’ কিম জং–উন সত্যজিতের সেই কল্পনার জগৎকে বাস্তবে নামিয়ে এনেছেন। গড়ে তুলেছেন সত্যিকারের এক হীরক রাজার দেশ, যেই দেশে ভোট থেকে হেয়ার কাট পর্যন্ত সবকিছুই করতে হয় সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী।
উত্তর কোরিয়া পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট একটা দেশ। সব মিলিয়ে এখানে বাস করেন ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। অবশ্য মানুষ না বলে তাঁদের ‘জন্মসূত্রে কিম জং–উনের বাধ্যগত প্রজা’ বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কারণ, মানুষ হয়ে জন্মালেও মানুষের কোনো অধিকার বা স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়নি। এমনকি তাঁদের বেঁচে থাকাও নির্ভর করে উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম জং–উনের ওপর।
মন্ত্রীকে গুলি করে হত্যা
২০১০ সালে উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে নিজে গুলি করে হত্যা করেন কিম জং–উন। তাঁর অপরাধ? কিমের ভাষণের সময় একটু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। মন্ত্রীর মতো প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর এক মানুষকেও যেখানে এত সহজে মেরা ফেলা যায়, সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থাটা কী, ভাবেন?
কেন মা সন্তানদের বাঁচালেন
বেশ কিছুদিন আগে উত্তর কোরিয়ার এক নারীর বাসায় ভয়াবহ আগুন লাগে। আগুনে বাড়ির সবকিছু পুড়ে যায়, কোনোমতে নিজের ও সন্তানদের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন মা। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই উত্তর কোরিয়ার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারণ? সে তাঁর বাড়িতে থাকা উত্তর কোরিয়ার মহান নেতাদের ছবির বদলে নিজের সন্তানকে আগুন থেকে বাঁচিয়েছিলেন। বাবা আর দাদার ছবি আগুনে পুড়ে গেছে, এই অপমান কীভাবে সহ্য করবেন কিম জং–উন?
কাজেই উত্তর কোরিয়ার সব ঘরেই কিম জং–উন, কিম ইল সাং এবং কিম জং ইলের ছবি রাখা শুধু বাধ্যতামূলকই নয়, বরং এই ছবিগুলোর যত্ন করতে হবে নিজের সন্তানের চেয়ে বেশি। যদি আগুনের সামনে আপনার সন্তান থাকে আর ওই ছবিগুলো থাকে, তাহলে আপনার সন্তান নয়, বরং আপনাকে আগে রক্ষা করতে হবে ওই ছবিগুলো।
জীবন্ত নরকে ২৮টি হেয়ার কাট
এভাবেই কিম জং–উন তৈরি করেছেন উত্তর কোরিয়া নামের এক জীবন্ত নরক, যে নরকে গান শোনা নিষিদ্ধ, বাইবেল পড়া নিষিদ্ধ, গরিবের সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ, ইন্টারনেট ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, এমনকি আপনার ইচ্ছেমতো চুলের স্টাইল করাও নিষিদ্ধ। ইচ্ছেমতো বাচ্চাদের নাম রাখাও নিষিদ্ধ।
২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের জন্য ২৮টি হেয়ার কাট স্টাইল ঠিক করে দেওয়া আছে। এর বাইরে কোনো স্টাইলই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি কারও স্টাইল যদি কিম জং–উনের সঙ্গে মিলে যায়, তবে তাঁকে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলা হবে বলে আইন করা আছে।
মৃত্যুভয়ে সদা ভীত কিম
এটা এমন এক দেশ, যে দেশে আপনি চাইলেও গাড়ি কিনতে পারবেন না। গাড়ি কেনার অনুমতি উত্তর কোরিয়ায় খুব কম মানুষেরই আছে। ফলে উত্তর কোরিয়ার রাস্তাগুলোও থাকে ফাঁকা, ছেলেপেলে ওখানে খেলাধুলা করে। মজার ব্যাপার হলো, কিম জং–উন নিজেও গাড়িতে চড়েন না।
প্রবল ক্ষমতা আর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ থাকার পরও সব সময়ই তিনি মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে থাকেন। ফলে জনসমক্ষে তাঁকে দেখা যায় না বললেই চলে। এমনকি অন্য দেশ সফরের সময়ও তিনি বিমান এড়িয়ে চলেন। যাতায়াত করেন ট্রেনে। তা–ও আবার একই সঙ্গে একই রাস্তায় তিন বা চারটি ট্রেন চালিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তিনি আসলে কোন ট্রেনে আছেন, সেটা যেন কেউ বুঝতে না পারে।
ভোটের প্রার্থী একজনই, ভোট দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক
সব মিলিয়ে ৩৯ বছর বয়সী কিম জং–উন উত্তর কোরিয়াকে আনন্দ, রং আর সৌন্দর্যবিহীন ধূসর এক জাহান্নামে পরিণত করেছেন, যে জাহান্নামে মানুষের প্রাণ থাকে, তবে সেই মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু থাকে না। অবশ্য উত্তর কোরিয়ার মানুষ ভোট দিতে পারেন। প্রতি পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া সেই নির্বাচনে প্রার্থী থাকেন একজনই। কিম জং–উন। ১০০ শতাংশ ভোট পেয়েই তাই তিনি নির্বাচিত হন প্রতিবার। সেই ভোট দিয়ে ভোটারকে আবার আনন্দও প্রকাশ করতে হবে। আর সেটা বাধ্যতামূলক!
এভাবেই হীরকের রাজা হয়ে বেঁচে আছেন কিম জং–উন নামের ভয়ংকর উন্মাদ এক শাসক। ভয়, আতঙ্ক, হুমকি আর হত্যা দিয়ে যিনি তৈরি করেছেন এক ত্রাসের রাজত্ব। যে রাজত্বের কথা রূপকথার পাতায় শুনতেও আমাদের ভয় হয়, সেই ভয়ংকর রূপকথাকে তিনি পরিণত করেছেন মূর্তিমান এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন এক সত্যে!