Bangladesh

এবারের গ্রীষ্মকালেও কি ব্যাপক হবে লোডশেডিং?

শীতের মৌসুম না কাটতেই– রাজধানীসহ সারাদেশে আবারও লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলে তা বেশি হচ্ছে।  

আসন্ন গ্রীষ্মকালে লোডশেডিং পরিস্থিতি কী হবে– তা ভেবে এখন থেকেই দুর্ভাবনায় আছেন জামালপুর সরিষাবাড়ি উপজেলার বয়রা গ্রামের সেচ পাম্প মালিক বজলুর রশিদ। শীতের শেষদিকেই বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্বেগজনক অবস্থার কথা উল্লেখ করে জানান, এতে তাঁর দুশ্চিন্তাই কেবল বাড়ছে।     

গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেন,  “আজকে মাত্র ১৮ শতাংশ জমিতে সেচ দিতে আমাকে বিদ্যুতের জন্য ৫ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ সময়ে ৩-৪ বার বিদ্যুৎ আসছে-গেছে। এখনো ঠিক মতো গরম পড়েনি, তাতেই যদি এত ঘনঘন বিদ্যুৎ চলে যায়; গরমের সময় কি অবস্থা হবে—তা নিয়ে টেনশনে আছি।” 

গত দুই-তিন ধরে দৈনিক ৬-৭ ঘন্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে বলেও জানান বজলুর রশিদ।

এভাবে শুধু জামালপুরেই নয়, শীতের মৌসুম না কাটতেই– রাজধানীসহ সারাদেশে আবারও লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলে তা বেশি হচ্ছে।  

সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করে বলছেন, আসন্ন গ্রীষ্মকালে লোডশেডিং পরিস্থিতি আগের বছরের মতো, বা তার চেয়েও খারাপ হতে পারে। ডলার সংকটের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি নিয়ে অনিশ্চয়তা, নতুন করে দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ বকেয়া এবং এবছর গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রা ও তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস- এই সংশয় আরও ঘনীভূত করছে। 

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-র তথ্যানুযায়ী, গত ২১ জানুয়ারির পর থেকে দুইদিন অন্তর লোডশেডিং করতে হয়েছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। আর চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে লোডশেডিং হয়েছে প্রতিদিনই। গত কয়েক দিনে দৈনিক সর্বনিম্ন ৫০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। 

গত ৭ ফেব্রুয়ারি এক তথ্যবিবরণীতে, চলতি মৌসুমে কৃষকদের রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত সেচ যন্ত্র পরিচালনার অনুরোধ জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে লোডশেডিংয়ের চাপ কমাতে এই অনুরোধ করা হয়।  

গত বছর গ্রীষ্মকালে লোডশেডিং ১,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়। গড়ে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা জ্বালানির অভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে গত গ্রীষ্ম মৌসুমে। এতে ঢাকায় দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা, এবং গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টাও লোডশেডিং করতে হয়েছিল।

৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়া অসহনীয় গরমের মধ্যে ভোক্তাদের, বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। সংকটে বাধ্য হয়ে দোকানপাট ও বাজার স্বাভাবিক সময়ের আগে বন্ধ করতে হয়েছিল। লোডশেডিংয়ের কারণে গত বছর বেশ কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন শহরে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। এছাড়া, তীব্র গ্যাস সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে দেশের শিল্প, কল-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যও বাধাগ্রস্ত হয়।

এইবার গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ হওয়ারও পূর্বাভাস দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।

আবহাওয়াবিদ এবং কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ”মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা ও আমেরিকান আবহাওয়া মডেল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়  ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চার মাস এবার বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হবে, এবং তাপমাত্রা বেশি থাকবে।”  

দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বর্তমানে মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। 

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ (পিক) চাহিদার বিপরীতে ২০২৩ সালের ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। ওই মৌসুমে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট ছিল। 

আসন্ন গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদার পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবে বলেও ধারণা করছেন তিনি। 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ– পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন টিবিএসকে বলেন, “বিদ্যুৎ বিভাগ যেভাবে পরিকল্পনা করছে, তাতে এবছর ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবছর নতুন করে ১,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। তাই গত বছরের তুলনায় লোডশেডিং কমার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।” 

“তবে যদি জ্বালানি আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটে এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্যে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয়– সেক্ষেত্রে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১,৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে” বলেও জানান মোহাম্মদ হোসাইন।

বিদ্যুৎ খাতে দেনার চাপ

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সংস্থার কাছে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার বকেয়া রয়েছে। এই দেনার বোঝা কমাতে, বিশেষত বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়া পাওনা পরিশোধে ৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করার পরিকল্পনা করছে সরকার। 

অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সব বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির বকেয়া পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করা হবে। এজন্য সরকারকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করতে হবে ।

এছাড়াও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে তেল-গ্যাস কিনতে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের সঙ্গে প্রায় ২১০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করেছে জ্বালানি বিভাগ।

২০০৯ সাল থেকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর দেশের নির্ভরতা অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত আমদানি-নির্ভরতা এখন সরকারের ওপর ব্যাপক আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে। গ্যাস ও কয়লা আমদানির জন্য রিজার্ভে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায়– গত বছর দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের চেয়ে কিছুবেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনেই সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। 

মোট ১৭০টি বিদ্যুৎ ইউনিটের মধ্যে গত বছর গ্রীষ্ম মৌসমে পূর্ণ সক্ষমতায় চলেছে মাত্র ৪৮টি; ৭৫টি চলেছে অর্ধেক সক্ষমতায়, এবং ৪৭টি ইউনিট অলস বসে ছিল।  তবে অলস বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও বড় অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, যা আর্থিকভাবে আরও চাপ সৃষ্টি করছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় উত্তোলন না বাড়িয়ে গ্যাস, এলএনজি ও কয়লার জন্য আমদানির নির্ভর হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। বিদ্যুৎ খাত আমদানি ও ঋণ-নির্ভর প্রকল্পগুলো নেওয়ার কারণেও আরও দেনা হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। 

জ্বালানি-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, “যে সংকট এখন বিরাজ করছে, সেটা একদিনে তৈরি হয়নি। প্রাইমারি সমস্যা হলো- এই খাতের পলিসি বিভ্রান্ত। দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন তৈরি এই খাতে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতাহীন করে তোলায় দুর্নীতি, অপচয় ও লুণ্ঠনের ফলে ব্যয় বেড়েছে।” 

ঋণ করে সাময়িকভাবে এখাতের ধার-দেনার সংকট এড়ানো গেলেও নীতিগত ত্রুটি দূর না করলে সংকট উত্তোরণের টেকসই সমাধান ও উন্নয়ন সম্ভব হবে না বলে মনে করেন এম শামসুল আলম।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, “বিদ্যুৎ বিভাগ এই পরিস্থিতি সমাধানের জন্য সক্রিয়ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষ করে সেচ মৌসুম, গ্রীষ্ম ও রোজায় যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন থাকে, সে লক্ষ্য নিয়ে এগোনো হচ্ছে। 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবায়নযোগ্য শক্তির অবকাঠামো তৈরি করা গেলে আমদানি করা বা স্থানীয় জ্বালানি সরবরাহের ওপর নির্ভর করতে হবে না। এতে বিদ্যুতখাতের টেকসই উন্নয়ন, সংকট সমাধান ও তুলনামুলক কম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। 

মোহাম্মদ হোসাইন বলেন- “আমাদের বর্তমান লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সংস্থান করা। কার্বন নিঃসরণকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ ক্লিন এনার্জি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d