Hot

কাজের সঙ্গে সংযোগহীন উচ্চশিক্ষা

গত বছর শিক্ষার একটি দপ্তরে হাজারখানেক কর্মচারী নিযুক্ত হয়। এসব পদের সবই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির। আবেদনের যোগ্যতা ছিল সর্বোচ্চ উচ্চমাধ্যমিক পাস। আবেদন পড়েছিল প্রায় ১১ লাখ। আবেদনকারীদের ৭০ শতাংশই ছিল স্নাতক। শুধু শিক্ষার এ দপ্তরই নয়, সরকারি সব চাকরির ক্ষেত্রেই প্রায় এক অবস্থা। উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা তৃতীয় শ্রেণির চাকরি করতেও দ্বিধায় পড়ছে না।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিকল্পনার অভাব প্রকট। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। পরিকল্পনা ছাড়াই সরকারি-বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স খোলা হচ্ছে, শিক্ষার মানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের তেমন সম্পর্ক নেই। বাড়ির কাছেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীরা চিন্তা না করে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু তারা শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে পারছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টি। উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী প্রায় সাড়ে ৪৭ লাখ। ছাত্র ৫৩ শতাংশ ও ছাত্রী ৪৭ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রায় ৪৪ লাখ ১৫ হাজার। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৩ লাখ ৪১ হাজার।

২০২২ সালে ৫০ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ৭ লাখ ২৫ হাজার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ২ হাজার ২৫৭। এসব প্রতিষ্ঠানে ছিল প্রায় ৩১ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৬৪৭টি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ৩ লাখ ১১ হাজার। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৪ লাখ ৩৩ হাজার। এ ছাড়া ১৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজে শিক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৭ হাজার।

ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আমাদের দেশে ১২ ক্লাসের পড়ালেখা বা ১৮ বছর শেষে চাকরি পাওয়ার সুযোগ কম। তাহলে তারা কোথায় যাবে? তারা উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হয়। এখন আমাদের দেখতে হবে প্রাথমিকে কত শিক্ষার্থী, এর কত অংশ উচ্চশিক্ষায় আসে। আমাদের উচ্চশিক্ষার সমস্যা হচ্ছে, তাদের আমরা চাকরির জন্য তৈরি করি না। আমাদের দরকার, উচ্চশিক্ষার সঙ্গে ট্রেডকোর্স, শর্টকোর্স। কারিগরিতে যদি শিক্ষার্থী নিতে হয়, তাহলে এ খাতকে আগে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। একসময় নার্সিংয়ে শিক্ষার্থী যেতে চাইত না, এখন যাচ্ছে। শিক্ষিত মানুষও যে সেলস ট্রেডে, হেয়ার কাটিংয়ে যেতে পারে তা সমাজকে বোঝাতে হবে।’

গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজের স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের ৪২ থেকে ৪৮ শতাংশ বেকার। তাদের ৩০ শতাংশের বেশি বিএ পাস। ২৩ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে স্নাতক। লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টে পাস করেছে প্রায় ২১ শতাংশ। বেকারদের ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ পাস করেছে ইসলামের ইতিহাস ও বাংলা বিষয়ে। তবে ইংরেজির স্নাতকরা কম বেকার। অর্থনীতি ও হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও বেকারত্বের শিকার হয়েছে কম। সামাজিক বিজ্ঞান এবং ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ের শিক্ষার্থীদের প্রায় ১ শতাংশ বেকার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে আছে প্রায় আট লাখ নারী-পুরুষ। অথচ মাধ্যমিক পাস করেছে এমন জনগোষ্ঠীর মাত্র ২ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৭ লাখ ৩৯ হাজার বেকার। উচ্চমাধ্যমিক পাস করাদের মধ্যে বেকারত্ব ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

জরিপ বলছে, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীর হার ২০১৭ অর্থবছরের ১১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ বছরে বেকার স্নাতকের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা ২০১৭ অর্থবছরে ছিল প্রায় ৪ লাখ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি জরিপ অনুযায়ীই দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার বাড়ছে। তারপরও সরকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়াচ্ছে। অনেক বিষয়েই পড়ালেখা করে খুব একটা চাকরির সুযোগ নেই। তারপরও সেসব বিষয় খোলা হচ্ছে। আগামীতে যেসব কর্মসংস্থানের সুযোগ উন্মোচিত হবে, সে অনুযায়ী পড়ালেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।

এশিয়ার মধ্যে দ্রুত উন্নতি করা সিঙ্গাপুরে ও মালয়েশিয়ায় উন্নয়নের প্রধান শর্ত হিসেবে ধরা হয় কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নকে। সিঙ্গাপুরে এ শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ ও মালয়েশিয়ায় ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশে এ শিক্ষার হার সরকার ১৭ শতাংশ দাবি করলেও বাস্তবে তা আরও অনেক কম। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও তার বেশিরভাগ মানহীন। ফলে শিক্ষার্থীদের এ শিক্ষায় খুব একটা আগ্রহ বাড়ছে না।

শিক্ষাবিদদের অভিমত, পদ্ধতিগত কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষাবিমুখ। অন্য দেশে প্রতিষ্ঠানই ঠিক করে দেয় শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় যাবে কি না। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তা করে না বা করতে পারে না। তাই একজন শিক্ষার্থীর ইচ্ছা থাকলেও কারিগরিতে সহজে যেতে পারে না। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রকৃত কারিগরি শিক্ষার সুযোগ কম। দক্ষতা ছাড়া কারিগরি শিক্ষা শেষে ভালো চাকরির সুযোগ থাকে না।

ব্রিটেনে শিক্ষাপদ্ধতিই ঠিক করে দেয় একজন শিক্ষার্থীর গতিপথ। সব শিক্ষার্থীর জন্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একই শিক্ষাব্যবস্থা থাকলেও নবম শ্রেণি থেকে মেধা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। অর্থাৎ একই ক্লাসে পড়লেও দুই ধরনের শিক্ষার্থীর জন্য দুই ধরনের প্রশ্ন হয়। থাকে ‘উচ্চতর গ্রুপ’, যারা ভবিষ্যতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। আর থাকে ‘ফাউন্ডেশন গ্রুপ’, যাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ কম। জিসিএসই বা ‘ও লেভেল’ শেষ করার পর তাদের কারিগরি অথবা ভোকেশনাল শিক্ষায় যেতে হয়। ফাউন্ডেশন গ্রুপের শিক্ষার্থীরা ‘এ লেভেল’-এ ভর্তি হতে পারবে না। উচ্চতর গ্রুপের শিক্ষার্থীরা ‘এ লেভেল’ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তারা ইচ্ছে করলে কারিগরি শিক্ষায়ও যেতে পারে।

আমেরিকার মতো বিশাল দেশে সর্বসাকল্যে ৫০০ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে আর আমাদের দেশে আছে আড়াই হাজারের বেশি। আমেরিকার উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো র‌্যাংকিংয়ে সামনের দিকে থাকলেও আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো র‌্যাংকিংয়ের একেবারে শেষের দিকে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এত বিশ্ববিদ্যালয় না করে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বেশি অর্থ বিনিয়োগ করা দরকার।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘এত শিক্ষার্থীকে অনার্স, মাস্টার্স না পড়িয়ে ডিপ্লোমা, কারিগরি বা দক্ষতাভিত্তিক কোর্স পড়ানো দরকার। এখন সবার প্রায় একই ধরনের এডুকেশন হওয়ায় এত শিক্ষার্থীর চাকরি পাওয়া কষ্টকর। তারা যদি এক-দুটি কোর্স করে বেরিয়ে যেত তাহলে সহজেই তারা চাকরির বাজারে ঢুকতে পারত। আমাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক নার্স, টেকনোলজিস্ট নেই। কিন্তু আমরা তাদের তৈরি করতে পারছি না। অন্যান্য খাতেরও একই অবস্থা। আগামী ১০-১২ বছরে জব মার্কেট বিবেচনায় দক্ষতাভিত্তিক ডিপ্লোমা কোর্স আমাদের বেশি দরকার।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor