Uncategorized

‘কেরামতি দেখে’ দেড় কোটি টাকা অন্যের হাতে তুলে দেন তিনি

এক বালতি পানির মধ্যে কিছু কাগজ ও এক হাজার টাকার নোট ছেড়ে দেন। কিছুক্ষণ পর পানিতে ভেসে ওঠে অনেকগুলো এক হাজার টাকার নোট। এমন চমক জাগানোর মতো কেরামতি দেখিয়ে আবদুল খালেক খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আস্থা অর্জন করেন তরিকুল ইসলাম। এরপর ফাঁদে ফেলে তাঁর কাছ থেকে ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা নেন তিনি।

ঢাকার কাফরুলের বাসিন্দা খালেকের প্রতারিত হওয়ার এ ঘটনার মামলা তদন্ত করে মাগুরার তরিকুলের অপকর্ম সম্পর্কে নানা তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর ভিত্তিতে সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন সিআইডির উপপরিদর্শক মোহাম্মদ আল মামুন।

মামলায় বলা হয়েছে, জিনের বাদশা পরিচয়ে তরিকুল আবদুল খালেক নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। প্রতারণার মাধ্যমে নেওয়া টাকায় তরিকুল ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রাইভেট কার ও একটি এক্সকাভেটর কেনেন। এ ছাড়া তরিকুল মাগুরায় ১০ শতক জমি কেনেন। তাঁর ব্যাংক হিসাবে ৩৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩৪ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

এর আগে ২০২১ সালে তরিকুলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় প্রতারণার মামলা করেন ভুক্তভোগী আবদুল খালেক। ওই বছরের ১০ মার্চ ওই মামলায় তরিকুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি। মামলাটি তদন্ত করে গত বছরের ১২ মার্চ তরিকুল ও তাঁর তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্য তরিকুলসহ অন্যরা প্রতারণার মাধ্যমে নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

তরিকুলের আইনজীবী ফেরদৌস সুলতানা বলেন, তাঁর মক্কেল তরিকুল জিনের বাদশা পরিচয়ে আবদুল খালেকের কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি। খালেকের সঙ্গে তরিকুলের টাকাপয়সার লেনদেন ছিল। খালেক এ বিরোধের জের ধরে তরিকুলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। খালেকের বিরুদ্ধেও মাগুরার আদালতে প্রতারণার একটি মামলা চলছে।

এ ব্যাপারে খালেক প্রথম আলোকে বলেন, সিআইডি তদন্ত করে তরিকুলের প্রতারণা ও জালিয়াতির তথ্য–প্রমাণ পেয়েছে। আর তরিকুল তাঁকে হয়রানি করার জন্য মাগুরায় তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছেন।

যেভাবে ফাঁদে পড়েন খালেক

মামলার কাগজপত্র ও ভুক্তভোগী খালেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাবনার আবদুল খালেক খান ২৫ বছর ছিলেন সৌদি আরবে। ২০০৪ সালে দেশে ফিরে ঢাকার কাফরুল এলাকায় তিনি বসবাস শুরু করেন। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন। স্ত্রী, দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে ভালো ছিলেন। পরে খালেকের স্ত্রী ও তাঁর এক ছেলে অসুস্থ হন। স্ত্রী ও ছেলেকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তবে তাঁর স্ত্রীর কিডনির সমস্য আরও বেড়ে যায়। খালেক একপর্যায়ে স্ত্রী ও সন্তানের অসুস্থতার কথা তুলে ধরেন পরিচিত খোকনের কাছে। পরে খোকনের মাধ্যমে তরিকুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তরিকুল তখন খালেককে বলেন, তাঁর কাছে জিন আসে। তিনি তাঁর স্ত্রী ও ছেলেকে সুস্থ করে তুলবেন।

মামলার এজাহারে খালেক দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেকে ওষুধ দেন তরিকুল। সেই ওষুধ সেবন করে তাঁরা দুজনই সুস্থ বোধ করেন। পরে তিনি তরিকুলকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন।

খালেক খান মামলায় বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও সন্তান কিছুটা সুস্থ হলে জিনের বাদশা তরিকুলের বিভিন্ন কেরামতি দেখতে থাকি। একপর্যায়ে জিনের বাদশা বলেন, আমাকে যখন তোরা এনেছিস, তখন তোদের আর কোনো দুঃখ–কষ্ট থাকবে না।’

খালেক মামলায় আরও বলেন, ‘জিনের বাদশা বলেন, বল, তোদের কত টাকার প্রয়োজন? আমি তখন জিজ্ঞাসা করি, কীভাবে টাকা দেবেন? তখন জিনের বাদশা বলেন, এক বালতি পানি দে। এক বালতি পানি দেওয়ার পর তরিকুল বালতির মধ্যে কিছু কাগজ ও এক হাজার টাকার নোট ছেড়ে দেন। তখন অনেকগুলো এক হাজার টাকার নোট তৈরি হয়।’

খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তরিকুল সব সময় বলতেন, তাঁর কাছে জিন আসে। দাতে টোকা দিলেই জিন চলে আসত। এরপর নানা কেরামতি দেখাতেন তরিকুল। কয়েকবার আমার হাতে টাকাও দিয়েছেন। একপর্যায়ে আরও অনেক টাকা বানিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। তখন তরিকুল বলেন, আরও টাকা বানিয়ে দেব। তবে একটা কাজ করতে হবে। পৃথিবীতে যত মসজিদ আছে, সেখানে পবিত্র কোরআন শরিফ কিনে দিতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করি, কত টাকার প্রয়োজন। তখন তরিকুল বলেন, জিনের বাদশা এসে বলে দেবে। পরে একটা পাত্রে রাখা কাগজ ওঠাতে বলেন তরিকুল। সেখানে লেখা ছিল, ৫৬ হাজার কোরআন শরিফ কিনতে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা প্রয়োজন। আমি টাকা দিতে রাজি হই।’

খালেক বলেন, এরপর তরিকুলের নির্দেশে তাঁকে ছয়টি প্যাকেট এনে দেন। এগুলোর মাধ্যমে তরিকুল তাঁকে কয়েক কোটি টাকা বানিয়ে দেবেন। পাশাপাশি কোরআন শরিফ কেনার জন্য তরিকুলকে টাকা দিতে থাকেন। তরিকুলের কথামতো নদীতে সাত লাখ টাকা ফেলে দেন বলে জানান তিনি।

খালেক আরও বলেন, তরিকুল একপর্যায়ে তাঁকে টাকা বানানোর প্যাকেট ধরিয়ে দেন। তবে কোরআন শরিফ কেনার পুরো টাকা না দেওয়া পর্যন্ত প্যাকেট খুলতে নিষেধ করেন। তরিকুলের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত তিনি তাঁকে ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা দেন। বাকি টাকা না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের দেওয়া টাকাভর্তি বাক্স খুলতে নিষেধ করেন তরিকুল। এরপর তরিকুল ও তাঁর সহযোগী আবদুল্লাহ যশোরে চলে যান। কোরআন শরিফ কেনার বাকি টাকা দিতে বলেন।

মামলায় খালেক দাবি করেন, ‘আমি ও খোকন তরিকুলের দেওয়া বাক্স খুলে দেখি, বাক্সে কেবল কাগজ। কোনো টাকা নেই।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেন, জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে তরিকুল ও তাঁর সহযোগী খালেকের কাছ থেকে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। আর খালেকের পূর্বপরিচিত খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে তরিকুল আমার সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। আমিও ফাঁদে পড়ে তাঁকে কয়েক লাখ টাকা দিয়েছিলাম।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button