চোরা স্বর্ণের ছোঁয়ায় ওরা সম্পদের চূড়ায়
নাসিরুদ্দিন– যশোরের বেনাপোল সীমান্তে গরু কেনাবেচার দালাল হিসেবে ছিল তাঁর নামডাক। একটা সময় সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালানে হাত পাকিয়ে গরুর দালালি ছাড়েন। স্বর্ণ চোরাচালান জগতে ঢুকে জাদুর চেরাগের ছোঁয়ায় পৌঁছে যান সম্পদের চূড়ায়। বাড়ি, গাড়ি, জমি– কী নেই শার্শার পুটখালীর বুদো সর্দারের ছেলে নাসিরুদ্দিনের! চারদিকে কোটি কোটি টাকার বিত্ত।
শার্শার এই নাসিরের মতো আরও কয়েকজন ‘ধনকুবের’ স্বর্ণ চোরাকারবারির অর্থ-সম্পদের খোঁজ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইমের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াড। সিআইডির আবেদনের পর গতকাল সোমবার স্বর্ণ চোরাচালানে নেমে বিপুল অর্থসম্পদ বানানো এমন ৯ কারবারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন যশোরের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত। এরই মধ্যে এ চক্রের অর্থ-সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, শার্শার ভবারবেড় এলাকায় ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ জমির ওপর মার্কেট রয়েছে নাসিরের। ওই মার্কেটের জমি কেনা ও নির্মাণে খরচ করা হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। যদিও বাস্তবে ওই জমির দাম ও নির্মাণ খরচ তিন থেকে চার গুণ। শার্শার বাগআঁচড়া এলাকায় ১ একর ৬ শতাংশ জমি কেনেন নাসির। ওই জমির দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া পুটখালীর ভিন্ন খতিয়ানে তাঁর আরও ৩৩ শতাংশ জমির খোঁজ মিলেছে। এমনকি বেনাপোলের ৪৮ নম্বর মৌজায় ২.৬৩ শতাংশ জমি রয়েছে নাসিরের নামে; যার দলিলমূল্য ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া পুটখালীর ১১০ নম্বর মৌজায় আরও ৩০ শতাংশ জমি আছে তাঁর। এ জমির বাজারমূল্যও কয়েক লাখ টাকা। নাসির একাই ‘টাকাওয়ালা’ হননি; স্ত্রী বিলকিস খাতুনের নামেও আছে অনেক সম্পদ। যশোরের ঝিকরগাছার কীর্তিপুরে ১৬ শতাংশ জমি কেনা হয়। ২০২২ সালের মে মাসে ওই সম্পদ কেনেন; যার দলিলমূল্য ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া বিলকিসের নামে পুটখালীর ১১০ নম্বর মৌজায় আরও ৯ শতাংশ জমি আছে। ওই জমির দাম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
স্বর্ণ চোরা চক্রের আরেক সদস্য ওলিয়ার রহমান। যশোরের ছোট আঁচড়া এলাকায় তাঁর নামে আছে জমিজমা। স্বর্ণ কারবারে জড়িয়ে আরও যারা সম্পদের শিখরে উঠেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন– রেজাউল করিম, রমজান আলী, সেলিম হোসেন, রুহুল আমিন, নাজমুল হোসেন ও আনিছুর রহমান। চক্রের সাত সদস্যকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; বাকি পাঁচজনকে খুঁজছে পুলিশ।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সিআইডির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত এই চক্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে বাহকের মাধ্যমে স্বর্ণবার এনে ভারতে পাচার করে আসছিল। চক্রের দুই শীর্ষ নেতা নাসিরুদ্দিন ও রমজান। রেজাউল ও রুহুল আমিনের মাধ্যমে তারা নতুন নতুন বাহক তৈরি করেন। বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভারতে অবৈধ পথে তারা স্বর্ণ পাচার করেন। এর বিনিময়ে সেখান থেকে অবৈধ উপায়ে ডলার বাংলাদেশে আনেন। এখন পর্যন্ত এ চক্রের প্রায় ১৪ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে আরও সম্পদ আছে কিনা, তা খুঁজে বের করতে গভীর অনুসন্ধান চলছে।
তদন্ত সূত্র বলছে, নাসিরুদ্দিনের পাঁচটিসহ চক্রের অন্য সদস্যদের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া জব্দ করা হয়েছে স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে গড়ে তোলা রিপা ফ্যাশন কর্নার, এম এম জুয়েলার্স, রোহা জুয়েলার্স ও নাসির ফার্মের ব্যাংক হিসাবও।
তদন্তে উঠে এসেছে, দুই উপায়ে চোরাই স্বর্ণের কারবার করতেন নাসির ও তাঁর সঙ্গীরা। প্রথমটি হলো, নিজেরাই বাহকের মাধ্যমে মাসিক চুক্তিতে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণ দেশে আনতেন। চার-পাঁচবার হাতবদলের পর ঢাকা থেকে সীমান্ত পর্যন্ত স্বর্ণ পৌঁছাত। ধাপে ধাপে তাদের ‘রেকি’ পার্টিও রয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, অন্য কোনো গ্রুপ চোরাপথে বাংলাদেশে স্বর্ণ আনলে তাদের কাছ থেকে কিনে নিতেন তারা। এর পর স্বর্ণের বার গলানোর পর ভারতে পাচার করতেন।
সিআইডির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, চক্রটি অনেক দিন চোরাই স্বর্ণের কারবার করে আসছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) বলছে, দেশের জল, স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে প্রতিদিন অন্তত ২০০ কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও বার অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে। এ হিসাবে এক বছরে টাকার অঙ্কে চোরাচালানের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সীমান্ত এলাকায় ধীরে ধীরে চোরাই স্বর্ণের চালান উদ্ধারের ঘটনা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে বিজিবির হাতে ধরা পড়ে ৫২৭ কেজি স্বর্ণ। আর গত ১০ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টমস হাউস, বিজিবি, পুলিশ ও এয়ারপোর্ট এপিবিএন সারাদেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে। তবে নানামুখী কার্যক্রমের পরও চোরাচালান বন্ধ হয়নি। মাঝেমধ্যে বাহক ধরা পড়লেও রাঘববোয়াল থাকছে পর্দার আড়ালে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতায় সোনার চালান ধরা পড়লেও বন্ধ হচ্ছে না পাচার। বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী এ চোরাচালানে জড়িত। পাশাপাশি রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যও। তাই কোনোভাবে স্বর্ণ পাচারের লাগাম টানা যাচ্ছে না। কিছুদিন পরপরই জব্দ হচ্ছে বড় চালান। অনেকে বলছে, যত সংখ্যক চালান ধরা পড়ছে, এর চেয়ে কয়েক গুণ ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে।