Bangladesh

ছোট গাড়িতে বড় দুর্ভোগে শহর

ভরদুপুর, রাজধানীর কাকরাইল মোড়। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ায় থেমে আছে দুই সড়ক। দুটি সড়কেই গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে গাড়িগুলো। হাতে গোনা কয়েকটি যাত্রীবাহী বাস বাদে বাকি সব ব্যক্তিগত গাড়ি। শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেটে ঘুরেও দেখা গেল একই দৃশ্য।

ছোট গাড়িতে বড় দুর্ভোগে শহরশুধু গতকাল বৃহস্পতিবারই নয়, ঢাকার রাজপথগুলোতে এমন দৃশ্য প্রতিদিনের। রাস্তায় ছুটে চলা বা সিগন্যালে থেমে থাকা বেশির ভাগ গাড়ি ব্যক্তিগত। মূলত ব্যক্তিগত গাড়ির জন্যই বেশির ভাগ সড়কে যানজট লেগে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও বাস্তবে উল্টো পথে হাঁটা হচ্ছে। গণপরিবহনের আশানুরূপ মানোন্নয়ন হচ্ছে না। এতে ব্যক্তিগত গাড়ির প্রতি উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার পালন করা হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১৬ সাল থেকে ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন শুরু হয়।

একসময় এই দিনে প্রতীকী হিসেবে রাজধানীর একটি সড়ক মানিক মিয়া এভিনিউকে গাড়িমুক্ত রাখা হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সেই কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। এমনকি এই বছর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দিনটি পালনে কোনো কর্মসূচি নেই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচল বাড়ার ক্ষতিকর দিক। গবেষণার তথ্য বলছে, স্বল্পসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের এই যান সড়কে ব্যাপক জায়গা দখল করে। একই সঙ্গে যেমন যানজট বাড়ায়, তেমনি বাড়ায় বায়ুদূষণ, কার্বন নিঃসরণের মাত্রা। ব্যক্তিগত গাড়িকে জনবান্ধব ও পরিবহনব্যবস্থার পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

গবেষণার তথ্য বলছে, মাত্র ৫ শতাংশ বাসে ৩০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব। অথচ ২৯ শতাংশ গাড়িতে যাত্রী পরিবহন করা হয় মাত্র ৫ শতাংশ।

পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে গণপরিবহনকে উৎসাহ দেওয়ার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দিকে নিতে হবে। ঢাকায় নগর পরিবহন কার্যকরভাবে জনপ্রিয় হলে হয়তো কিছু পথে ব্যক্তিগত গাড়ি কমে যেত। শুধু এটা নয়, কাগজে-কলমে এমন অনেক ভাবনাই আছে, যা বাস্তবে নেই। গণপরিবহনকে শৃঙ্খলায় আনতে, সংখ্যা বাড়াতে, সেবার মান বাড়াতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছার অভাব আছে বলে মনে হয়।’

মূলত সড়কে পরিবহন চলাচলের অনুমতিস্বরূপ যানের নিবন্ধন দিয়ে থাকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

১৯৭২ থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত যানবাহনের নিবন্ধন দেওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সারা দেশে বাসের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা প্রায় আট গুণ। তবে যে হারে বাস বেড়েছে, সেই অনুপাতে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়েনি। যদিও অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি বেড়েছে।

বিআরটিএর তথ্য বলছে, ১৯৭২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৩৮৫। ২০২৩ সালের আগস্টে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৯২৯। একইভাবে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল দুই লাখ সাত হাজার ৯৮৯টি, যা ২০২৩ সালের আগস্টে চার লাখ পাঁচ হাজার ৯৩৩টি হয়েছে। গত ১২ বছরে সারা দেশে বাসের সংখ্যা বেড়েছে ১৩০ শতাংশ। ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে ৯৫ শতাংশ।

তবে রাজধানী ঢাকার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এখানে ২০১০ সালে নিবন্ধিত বাস ছিল ১৫ হাজার ১৮টি। ২০২৩ সালের আগস্টে এসে হয় ৪১ হাজার ১৮৫টি। আর ২০১০ সালে নিবন্ধিত ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল এক লাখ ৬০ হাজার ১৭০টি। এটি ২০২৩ সালের আগস্টে হয় তিন লাখ ৩৬ হাজার ২২৬টি। এই সময়ে ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে ১১০ শতাংশ।

অঙ্কের হিসাবে, বাস শতাংশের হারে বাড়লেও সংখ্যায় কম। আবার ব্যক্তিগত গাড়ি শতাংশের হারে পিছিয়ে থাকলেও বাসের আট গুণ। এক-তৃতীয়াংশ গণপরিবহন অচল অবস্থায় রয়েছে। ঢাকায় নিয়মিত চলে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার হাজার বাস। সড়কে বেশির ভাগ সময়ই থাকে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ।

গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে দুর্ঘটনা। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০ হাজার ৩২৮ জন মারা গেছে। এ সময়ের নিরাপদ সড়ক চাইয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১০ বছরে ৩২ হাজার ৭৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় অন্তত ৮০ হাজার ৩১৬ জন আহত হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অতিরিক্ত বাড়ছে, এটা ঠিক। অনেকে নতুন গাড়ি কিনলেও পুরনো গাড়ি রয়ে যাচ্ছে। গাড়ির সংখ্যা একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা দরকার। এ জন্য ডিটিসিএ (ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ) কাজ করছে। নিয়মের মধ্যে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়, সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’

এ ব্যাপারে পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জমান বলেন, ‘ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের কথা আমরা মুখে বলছি ঠিকই, কিন্তু নীতিনির্ধারণী জায়গায় একেবারে উল্টো পথে হাঁটছি। গণপরিবহন প্রাধান্য দিতে চাই বলি, কিন্তু গণপরিবহনের মান উন্নত করি না। পাশাপাশি আমরা যে ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ দেখছি, এগুলো মূলত ব্যক্তিগত গাড়িকে আরো উৎসাহিত করছে। সংগত কারণে ব্যক্তিগত গাড়িও বাড়ছে।’

এদিকে বায়ুদূষণের পেছনে অন্যতম কারণ যানবাহন। ২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) যৌথভাবে একটি গবেষণা করে। সেখানে বলা হচ্ছে, ঢাকা শহরের যেসব এলাকায় যানজটের মাত্রা বেশি, সেখানে বায়ুদূষণের পরিমাণও বেশি। মোট বায়ুদূষণের ২০ থেকে ২৫ শতাংশের জন্য দায়ী যানবাহন।

ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘পরিবেশ বাঁচাতে সড়ক থেকে আনফিট গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়ি কমানোর কোনো বিকল্প নেই। গণপরিবহনের মান ভালো করা এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়িকে নিরুৎসাহ করা সম্ভব।’

কিন্তু জনসচেতনতা বাড়াতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে না। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক সাবিহা পারভীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার দিবসটি পালনের জন্য আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। তবে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেছি। অনুমোদন পেলে আগামী বছর থেকে জাতীয় দিবস হিসেবে দিনটি পালন করা হবে।’

ঢাকার পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থায় উদ্বেগজনক হারে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে গতকাল ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এক বিবৃতিতে বলেছে, নীতিনির্ধারকরা গণপরিবহন ব্যবহার করলেই সাধারণ মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগ উপলব্ধি করতে পারবেন। আমাদের ঢাকা শহর কী পরিমাণ ব্যক্তিগত গাড়ি ধারণ করতে পারবে, সেই বিষয়ে বিআরটিএ, ডিটিসিএ, ট্রাফিক বিভাগ, রাজউক ও সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা নেই। ঢাকা শহরে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন দিচ্ছে বিআরটিএ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button