দুই দলেরই ‘এক দফা’; দিচ্ছে কোন বার্তা?
সমাবেশে দুই দলের অনড় অবস্থানের প্রকাশ ঘটলেও এখানেই শেষ দেখছেন না বিশ্লেষকরা।
ঢাকায় বুধবারে নিজ নিজ দলের সমাবেশে ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উভয়ই এক দফার ঘোষণা দেন।
সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী অনুসন্ধানী দলের পাশাপাশি যুক্তরােষ্ট্রর কূটনীতিকরাও বাংলাদেশে, তখন নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে ঢাকায় পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
সেই সমাবেশে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানেই থাকল দুই দল, যা নিয়ে মতপার্থক্য এক যুগ ধরেই চলছে। উল্টো সমাবেশে দুই দলই ‘এক দফা’র ঘোষণা দিয়েছে।
বিএনপি বলেছে, সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। আর আওয়ামী লীগ বলেছে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই নির্বাচন হবে।
তাদের ঘোষণায় রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবর্তে যার যার অনড় অবস্থানে থাকারই আঁচ পাওয়া গেল। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘাত এড়াতে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগোতে হবে দুই পক্ষকেই।
ভোটের আরও কয়েক মাস বাকি থাকতে প্রকাশ্য সমাবেশের ঘোষণায় উত্তাপ ছড়ালেও অপ্রকাশ্যে দুই পক্ষের রফা হতে পারে বলেও আশা করছেন তাদের কেউ কেউ।
২০১১ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে দেশের রাজনীতিতে বিরোধ চলছে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও কারচুপির অভিযোগ তুলে বলে, এই ভোট নির্দলীয় সরকারের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি পুরনো দাবিটি জোরেশোরে তুললেও টানা এক যুগ ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেই দাবিতে নত হতে নারাজ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে বিদেশিদের তৎপরতা আগে দেখা গেছে বহুবার। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দুই পক্ষের সমঝোতায় আনতে এসেছিলেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।
এবার নির্বাচনের আগে পশ্চিমা দেশগুলোর নানা কথা ও পদক্ষেপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা হয়ে যারা দাঁড়াবে, তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পথ বন্ধ করতে ওয়াশিংটন নতুন ভিসা নীতি প্রণয়ন করেছে।
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোটের তাগিদ দিয়ে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কয়েকদিন আগেই একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে, যাদের কাজ হচ্ছে প্রাক-নির্বাচনী অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে আলোচনা করা।
চার দিনের সফরে একদিন আগে ঢাকায় এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। তার সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিট্যান্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লুও রয়েছেন।
তাদের অবস্থানের মধ্যেই নিজ নিজ সমাবেশ থেকে ‘এক দফা’র ঘোষণা দিলেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা।
ফখরুল-কাদের পাল্টাপাল্টি
ঢাকার নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির সমাবেশটি হয়; তার এক কিলোমিটার দূরে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ পাশের সড়কে হয় আওয়ামী লীগের সমাবেশ।
সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের দাবি তুলে ধরে বলেন, “আমরা যারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, তারা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজকে আমরা একটা যৌথ ঘোষণা দেব যার যার জায়গা থেকে। সেই সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণআন্দোলনের এক দফার ঘোষণা। আর কোনো দফা নাই।
নয়া পল্টনে দলীয় কার্যাালয়ের সামনে সমাবেশ করে বিএনপি
“বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী, অবৈধ সরকারের পদত্যাগ … এক দফা এক দাবি কী? বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং নির্বাচন কমিশন পূনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূল নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।”
পদযাত্রার ‘প্রাথমিক’ কর্মসূচি ঘোষণা করে চরম অবস্থানে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, “এরপরেও আঙ্গুলে ঘি যদি না উঠে, তাহলে কী করে ওঠাতে হয়, এদেশের মানুষ তা জানে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সমাবেশে বলেন, “যারা আমাদের নেতা-কর্মী, সাধারণ জনগণের মন কেড়ে নিয়েছে, তাদের সাথে কোনো আপস নাই। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। যারা যাবে, তাদেরকেও জবাব দিতে হবে।”
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান বলেন, “জনগণ আজকে রাস্তায় নেমে এসেছে। শেখ হাসিনার পায়ের নিচে মাটি নেই। এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার আর সুযোগ নেই।”
এর ঠিক বিপরীত বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগের সমাবেশে। ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপির এক দফা শেখ হাসিনার পদত্যাগ, আর আমাদের এক দফা শেখ হাসিনা ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। আমাদের এক দফা (শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন) সংবিধানসম্মত নির্বাচন। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সফরের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “যে বিদেশি বন্ধুরা এসেছেন, আপনারা চান ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল, সুষ্ঠু নির্বাচন। আমাদের লক্ষ্যও ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল, সুষ্ঠু নির্বাচন। এই ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল, সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা দিতে আসবে, আমরা তাদের প্রতিহত করব।”
ইইউ প্রতিনিধি দলের জ্যেষ্ঠ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ রিকার্ডো শেলেরি ইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে
সমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, “বিভিন্ন দেশের লোকজন আমাদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। আপনারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী, আপনাদের আমরা সম্মান করি। তবে বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এই পবিত্র সংবিধানে কোনো দেশ হস্তক্ষেপ করলে বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না।”
বিএনপি ‘বিদেশি ঘটক’ নিয়ে এসেছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
রফা হবে?
দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে উদ্বেগ ছড়ালেও সমঝোতার আশা হারাচ্ছেন না রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা।
দলগুলোর অনড় অবস্থান নাগরিকদের শঙ্কিত করে তোলে বলে মনে করেন বেসরকারি সংগঠন ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানে আগামী নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, সে সংশয় দৃঢ় হবে মানুষের কাছে।”
‘সমঝোতার বিকল্প নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কয়েক মাস পরে জাতীয় নির্বাচন। আজ ঘোষণা এল এক দফার, অনড় অবস্থানের। এক দফা বলে কিছু নেই রাজনীতিতে। রাজনীতিতে আছে নেগোসিয়েশন। এত তাড়াতাড়ি এক দফা ঘোষণা দেওয়া এক ধরনের অকালপক্কতা।
“দুই দলকেই স্বউদ্যোগী হয়ে জনগণের কথা ভেবে আলোচনা করতে হবে, সমঝোতায় আসতে হবে। সবচেয়ে ভূমিকা ক্ষমতাসীন দলের। দুই দলই গোঁ ধরে রাখলে এ ইমিচ্যুরিটি জন্য মাশুল দিতে হবে।”
বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ পাশের সড়কে সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা
সরকারি দলকে নমনীয় হওয়ার পরামর্শ দেন শরমিন, বিরোধী দলকেও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
পাল্টাপাল্টি ‘এক দফা’য় শঙ্কা দেখছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরও।
তার মতে, পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে সমাবেশের কারণে ইতোমধ্যে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এটি মাত্র শুরু হয়েছে। এ ধরনের মহড়া চলতে থাকলে উদ্বেগ আরও বাড়বে।
সমঝোতার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে দুই দলকে। সমঝোতা না হলে সংঘাতের দিকে যাবে। প্রতিবার নির্বাচন এলেই শঙ্কার মধ্যে থাকলে চলবে না। একটা সমঝোতা হলে তা আগামীর জন্যও ভালো।”
ইইউর প্রাক-নির্বাচনী অনুসন্ধানী দলের সফর সমঝোতার একটি চাপ তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন এই কূটনীতিক।
এদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম মনে করছেন, প্রকাশ্য সমাবেশে দল দুটির এমন ঘোষণা আসলে চাপ তৈরির একটি কৌশল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা যেসব কথা বলছে, ঘোষণা দিচ্ছে তাতে একটা মানসিক চাপ হচ্ছে। এতে প্রেসার ক্রিয়েট করা, যাতে যতটুকু সম্ভব দাবি আদায় করা যায়। শেষ পর্যন্ত কী হয়, দেখা যাবে।”
তবে দল দুটি গোঁ ধরে থাকলে ‘সংঘাত অবশ্যম্ভাবী’ বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।
এমন সংঘাত-সহিংসতা বহু বার দেখেছে বাংলাদেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদারও মনে করেন, ‘এক দফা’ অনড় কোনো অবস্থান নয়। সমঝোতার সময় এখনও রয়েছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকের দু’দলের এক দফা বা পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে বলে মনে করি না। যে কোনো দেশেই নির্বাচন কাছাকাছি এলে দলগুলো একটু উচ্চকণ্ঠ হয়।”
সমঝোতার আশা রেখে তিনি বলেন, “প্রকাশ্যে যা-ই হোক না কেন, এর বাইরেও বড় দলগুলোর মধ্যে একটা রফা হতে পারে।”
বিদেশিরা যেন সুযোগ নিতে না পারেন, সেজন্য দেশের রাজনীতিকরা নিজেদের উদ্যোগেই যেন সমঝোতা করে নেন, সেটাই চান এই অধ্যাপক।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার নজির সবখানে রয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কার্যক্ষেত্রের বাইরে স্বাধীন দেশে তাদের ‘স্বার্থ চরিতার্থ করাটা’ কোনোভাবে ঠিক নয়।
“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে সমঝোতায় ভুমিকা নিতে পারে- এটুকু নিতে পারি। এর বাইরে ডিকটেট করলে তা নিতে পারি না। আমি মনে করি, ‘দেশি সমাধান’ আসা উচিৎ। নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য আলোচনা হতে পারে।”