Bangladesh

দুর্নীতিতে দশ নম্বর বাংলাদেশ

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে দশম, যা গত বছর ছিল ১২তম। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন ২০২৩-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ধানম-িতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে বার্লিনের সঙ্গে একযোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।

এদিকে সারা বিশ্বেই কমবেশি দুর্নীতি আছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দুর্নীতির অপবাদটা যেভাবে বাংলাদেশ নিয়ে দেওয়া হয়, তা মোটেও সত্য নয়।

দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্কোর হয়েছে ২৪। সমান স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকান রিপাবলিক, ইরান, লেবানন ও জিম্বাবুয়ে।

এর আগে ২০২৩ সালে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৫। আর তালিকায় দেশ হিসেবে ১৪৭তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। যেখানে এবার ১৪৯তম।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিপিআই (দুর্নীতির ধারণা সূচক) অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। সিপিআই ২০২৩ অনুযায়ী এ বছর বাংলাদেশের স্কোর ২০২২-এর তুলনায় ১ পয়েন্ট কমে ২৪। নিম্নক্রম অনুযায়ী অবস্থানের দুই ধাপ। অবনতি হয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম এবং ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী ১৪৯তম। সূচকের বিশ্লেষণ করলে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থান গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন। স্কোর ও অবস্থানের এ অবনমন প্রমাণ করে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ ঘোষণা বাস্তবিক অর্থে কার্যকর প্রয়োগ হয়নি। বরং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আরও অবনতি হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান ও স্কোর যথারীতি বিব্রতকরভাবে আফগানিস্তানের পর।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিপিআইয়ে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, ইকোনমিক ইন্টেলিজেনস ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী, ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্র্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় সিপিআই স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৮, ৩৬ ও ২৯। অথচ বাংলাদেশের স্কোর ২৪। এমনকি ফ্রিডম হাউজ অনুযায়ী, যেসব দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র আছে এমন ৯৩টি রাষ্ট্রের গড় ৫৩ এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রসমূহের গড় স্কোর ৩১ সেখানেও বাংলাদেশের ২৪ স্কোর, উদ্বেগজনক ও বিব্রতকর। দুর্নীতি ও অবিচার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, দুর্নীতি অন্যায়ের জন্য দেয় এবং অন্যায় দুর্নীতির দুষ্টচক্র তৈরি করে। সিপিআইয়ের তথ্য আরও প্রমাণ করে, যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রয়েছে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্ষিত সেসব দেশের কার্যকর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বেশি।

সিপিআই উপস্থাপনায় বাংলাদেশের নিম্ন অবস্থানের ব্যাখ্যা তুলে ধরে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত কয়েক বছর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’র সবচেয়ে আলোচিত মেয়াদ ছিল। কিন্তু এই মেয়াদে এ ঘোষণাকে চর্চায় রূপ দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কৌশলনির্ভর কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি; উপরন্তু এ মেয়াদে দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি ক্রয় ও বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে দুর্নীতির অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ সময়কালে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এলেও এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে জর্জরিত ব্যাংক খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি, বরং এর জন্য যারা দায়ী তাদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমনে কার্যকর দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিতে কার্যকরতা দেখাতে পারেনি। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে অর্জিত ক্ষমতার অবস্থানকে অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির ফলে অবিচার বাড়ে। দুর্নীতি ও অবিচারের মধ্যে একটি দুষ্টচক্র রয়েছে। গণতান্ত্রিক চর্চা ও নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত যেসব দেশে সূচকে ভালো স্কোর করে। তিনি মনে করেন, দেশে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের জন্য একধরনের নজরদারিভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ও হুমকির পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ সমালোচনা সহ্য করার অসহিষ্ণুতা। তাছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ার সুযোগ নেই। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা। দুর্নীতির তুলনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সূচক। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তাদের কাছে এ প্রতিবেদনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়।

পরিস্থিতি বদলানোর সম্ভাবনা দেখেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে টিআই কথা বলে, গণমাধ্যম বলে, সরকারও বলে। নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো কথা বলা হয়। ইশতেহার কাগজে-কলমেই থেকে যায়, দলগুলো ফিরেও তাকায় না। এবারও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বলা হয়েছে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জনস্বার্থে কাজ করবেন। আমরা আস্থা রাখতে চাই।

টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, যখন দুর্নীতি, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলি, তখন তারা ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। সরকারের লোকজন এমনভাবে কথা বলেন, সবাই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। একটা কথা বললে সেটাকে স্বীকৃতি দিয়ে দুর্নীতিকে কমানোর মানসিকতা নিয়ে তারা কাজ করেন না।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম, সমন্বয়ক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

এদিকে টিআইবির প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, টিআইবি তো বিএনপির দালাল, বিএনপি যা বলে, টিআইবিও তা বলে। এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু রাজনৈতিক ইন্টারেস্ট আছে। বিশ্ব জুড়ে ক্ষমতার যে দ্বন্দ্ব, সেখানে অবস্থানগতভাবে কোনো কোনো জোট বা দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের পাহারাদার এসব প্রতিষ্ঠান। ওখানে কারও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এসব কমেন্ট (মন্তব্য) করা হয়। এসব অপবাদ দেওয়া হয়। এটা অতীতেও দেওয়া হয়েছে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা এগুলোর পরোয়া করি না। জনস্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি। করাপশন ইজ ওয়ে অব লাইফ অ্যাক্রোস দ্য ওয়ার্ল্ড নাও। এটা বাংলাদেশের ব্যাপার নয়, সারা বিশ্বেই আছে কমবেশি। কিন্তু যেভাবে অপবাদটা বাংলাদেশ নিয়ে দেওয়া হয়, এটা মোটেও সত্য নয়।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button