Bangladesh

দেশের পণ্য রপ্তানির ৭৬ শতাংশই ১২ বাজারে

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির তিন-চতুর্থাংশ বা ৭৬ শতাংশই হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ ১২টি দেশে। এই দেশগুলোর প্রতিটিতে রপ্তানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। এর মধ্যে নতুন করে বিলিয়ন ডলার ক্লাবে যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার নাম।

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২৭০ কোটি টাকা (রপ্তানিতে প্রতি ডলার ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা ধরা হয়)। শীর্ষ ১২ রপ্তানি গন্তব্য তথা দেশে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ২০৪ কোটি ডলারের পণ্য। তার আগের বছরে এই বাজারগুলোতে রপ্তানি হয়েছিল ৪ হাজার ১১ কোটি ডলারের পণ্য। এসব দেশে এক বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১৯৩ কোটি ডলারের।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষ ১২ রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, ভারত, জাপান, পোল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। এই দেশগুলোর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও পোল্যান্ডে রপ্তানি কমেছে। বাকি ৯টি বাজারে পণ্য রপ্তানি ৭ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষ রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এই বাজারে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো রপ্তানি ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর আগে অন্য কোনো বাজারে পণ্য রপ্তানি এই মাইলফলক ছোঁয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেওয়ায় আলোচ্য অর্থবছরে পণ্যের চাহিদা কমে যায়। ফলে প্রধান বাজারটিতে রপ্তানি কমে ৯৭০ কোটি ডলারে নামে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশের মতো কম। যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির ৮৮ শতাংশই তৈরি পোশাক।

বাংলাদেশি পণ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গন্তব্য জার্মানি। মাঝখানে কয়েক মাস অবশ্য এই দেশ শীর্ষে গন্তব্য হয়ে উঠেছিল। বিদায়ী অর্থবছরে দেশটিতে ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি হয় ৭৫৯ কোটি ডলারের রপ্তানি। তার মানে গত অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি কমেছে পৌনে ৭ শতাংশ। জার্মানিতে আলোচ্য অর্থবছরে মোট রপ্তানির ৯৪ শতাংশ ছিল তৈরি পোশাক, যার মূল্যমান ৬৬৮ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি হয় হোম টেক্সটাইল পণ্য। এটির রপ্তানি মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ।

শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্যগুলোয় বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য রপ্তানির জন্য প্রতিযোগিতামূলক দাম, মানসম্মত পণ্য ও ব্র্যান্ড ভ্যালু গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা বেশি থাকলেও আমরা সেই জায়গায় পিছিয়ে আছি।

মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি।  

যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বের হয়ে গেলেও দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেনি। গত অর্থবছরে দেশটিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয় ৪৮২ কোটি ডলারের পণ্য। বাজারটিতে শীর্ষ তিন রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক, ৫০৩ কোটি ডলার; হোম টেক্সটাইল, ৮ কোটি ডলার এবং হিমায়িত চিংড়ি, ৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।

বাংলাদেশি পণ্যের চতুর্থ শীর্ষ আমদানিকারক হচ্ছে ইইউভুক্ত স্পেন। দেশটিতে বিদায়ী অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে ৩৬৮ কোটি ডলারের পণ্য, যা তার আগের বছরের ৩১৭ কোটি ডলারের চেয়ে ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো এই বাজারেও শীর্ষ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। স্পেনে মোট রপ্তানির ৯৭ শতাংশই তৈরি পোশাক।

ইইউভুক্ত আরেক দেশ ফ্রান্স বাংলাদেশি পণ্যের পঞ্চম শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য। গত অর্থবছরে দেশটিতে ৩২৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার আগের অর্থবছরে দেশটিতে পণ্য রপ্তানি হয় ২৭১ কোটি ডলারের। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি বেড়েছে ২১ শতাংশ। ফ্রান্সেও তৈরি পোশাকই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। দেশটিতে গত অর্থবছর ২৯৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা মোট রপ্তানির ৮৯ শতাংশ। বাজারটিতে ১৯ কোটি ডলারের জুতা ও ৮ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে বিদায়ী অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে বিলিয়ন ডলার ক্লাবে থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ২৩৯ কোটি ও নেদারল্যান্ডস ২০৯ কোটি ডলারের পণ্য নিয়েছে। এর মধ্যে ইতালিতে ৪০ ও নেদারল্যান্ডসে পৌনে ১৮ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে। এ ছাড়া ভারতে ২১৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই বাজারে রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশের মতো।

২০২২-২৩ অর্থবছরে জাপানে ১৯০ কোটি ও পোল্যান্ডে ১৮৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। জাপানে রপ্তানি ৪০ শতাংশ বাড়লেও পোল্যান্ডে ১৩ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া গত অর্থবছরে কানাডায় ১৭২ ও অস্ট্রেলিয়ায় ১২৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে কানাডায় ১৩ শতাংশ ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩৭ শতাংশের মতো রপ্তানি বেড়েছে।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে মোট রপ্তানির ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। তবে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, পোল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় মোট রপ্তানির ৯২-৯৭ শতাংশ তৈরি পোশাক। আর যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জাপান ও কানাডায় মোট রপ্তানির ৮৪ থেকে ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক। আর ভারতে মোট রপ্তানির ৪৭ শতাংশ তৈরি পোশাক।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্যগুলোয় বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য রপ্তানির জন্য প্রতিযোগিতামূলক দাম, মানসম্মত পণ্য ও ব্র্যান্ড ভ্যালু গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তি পণ্যের চাহিদা বেশি থাকলেও আমরা সেই জায়গায় পিছিয়ে আছি। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) মাধ্যমে এই জায়গায় উন্নতি করা সম্ভব। যদিও বাংলাদেশে এফডিআই আসার হার খুবই কম।

মোস্তাফিজুর আরও রহমান বলেন, দেশে এফডিআই কেন আসছে না সেদিকে নজর দিতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করার জন্য সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ সই করছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সেসব এমওইউর বড় অংশের মৃত্যু ঘটছে। এই মৃত্যুহার কমাতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে নিষ্কণ্টক জমি প্রাপ্তির বাধা দূর হয়েছে। বিডার ওয়ান–স্টপ সার্ভিস বা এক জায়গায় সব সেবা কার্যকর করতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবাগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button