নিউইয়র্ক টাইমসের তদন্তে ফিলিস্তিনি বন্দী নির্যাতনের যে রোমহর্ষ চিত্র উঠে এল
![](https://miprobashi.com/wp-content/uploads/2024/06/prothomalo-bangla_2023-12_a8baf459-0921-4619-a748-7e3704667e3e_Palestine-780x470.webp)
ইসরায়েলের এসদে তেইমান বন্দিশিবিরে আটক ফিলিস্তিনিদের নিপীড়ন-নির্যাতন ও তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের রোমহর্ষ চিত্র উঠে এসেছে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি তদন্তে। তিন মাস ধরে এ তদন্ত চালানো হয়।
ওই শিবিরের সাবেক বন্দী, ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও সেনাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ তদন্তকাজ পরিচালনা করা হয়। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে শিবিরটিতে বন্দী আছেন চার হাজারের মতো ফিলিস্তিনি।
এসদে তেইমান বন্দিশিবিরের অবস্থান দক্ষিণ ইসরায়েলের একটি সামরিক ঘাঁটিতে। শিবিরটি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার ইসরায়েলি সেনাদের হাতে আটক হওয়া লোকজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের কাজে ব্যবহৃত একটি অস্থায়ী স্থাপনা।
ইসরায়েলি আইনে ‘বেআইনি যোদ্ধা’ এই বন্দীদের বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ৭৫ দিন পর্যন্ত ও কোনো আইনজীবী বা বিচারের মুখোমুখি করা ছাড়া ৯০ দিন পর্যন্ত আটকে রাখার বিধান আছে। তাঁদের অবস্থানস্থল সম্পর্কে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, এমনকি আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটিকেও জানতে দেওয়া হয় না; যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তদন্ত চলাকালে শিবিরটির সাবেক বন্দীরা ইসরায়েলি সেনাদের হাতে বেধড়ক মারপিট, বৈদ্যুতিক শক, অমানবিক আচরণ, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়ার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদকালে তাঁদের ঘুষি ও লাথি মারা হয়েছে। পেটানো হয়েছে লাঠি-রাইফেলের বাঁট ও ধাতব দ্রব্য শনাক্ত করার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র দিয়ে।
তদন্ত চলাকালে শিবিরটির সাবেক বন্দীরা ইসরায়েলি সেনাদের হাতে বেধড়ক মারপিট, বৈদ্যুতিক শক, অমানবিক আচরণ, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়ার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন। এই বন্দীদের আটজন ওই শিবিরে আটক ছিলেন বলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তরফে নিশ্চিত করা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদকালে তাঁদের ঘুষি ও লাথি মারা হয়েছে। পেটানো হয়েছে লাঠি-রাইফেলের বাঁট ও ধাতব দ্রব্য শনাক্ত করার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র দিয়ে।
সেনাদের মারধরে পাঁজরের হাড় ভেঙে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন দুজন বন্দী। তাঁদের একজন দাবি করেছেন, তাঁকে হাঁটু দিয়ে বুকে আঘাত করা হয়েছেন। অন্যজন বলেছেন, তাঁকে লাথি দেওয়া হয়েছে এবং রাইফেল দিয়ে মারা হয়েছে। সাতজন বন্দী বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁদের শুধু ডায়াপার পরে থাকতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার দাবি করেছেন তিনজন বন্দী।
দ্য টাইমসের এ তদন্তে যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্রও উঠে এসেছে। এমন নির্যাতনের শিকার হওয়া বন্দীদের একজন ৩৯ বছর বয়সী জ্যেষ্ঠ নার্স মোহাম্মদ আল-হামলাবি। নিজের দুঃসহ স্মৃতির কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, একজন নারী সেনা কর্মকর্তা দুই সেনাসদস্যকে নির্দেশ দেন তাঁকে ওপরে তুলে ধরতে। এরপর মেঝেতে লাগানো একটি ধাতবখণ্ডের ওপর তাঁকে রেখে চাপ দিলে সেটি পায়ুপথে ঢুকে যায়। এতে রক্তপাত ও অসহনীয় যন্ত্রণা হয় তাঁর।
![ফিলিস্তিনি বন্দীদের এভাবে নিপীড়নের ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরায়েল](https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2024-01%2F6e949c4c-f393-4017-9927-357aa0f7d462%2Fpalestinains_israel_1.webp?auto=format%2Ccompress&fmt=webp&format=webp&w=640&dpr=1.3)
ফিলিস্তিনি বন্দীদের এভাবে নিপীড়নের ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরায়েল
এদিকে ফিলিস্তিনবিষয়ক জাতিসংঘের মূল সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর ফাঁস হওয়া এক খসড়া প্রতিবেদনেও ফিলিস্তিনি বন্দী নির্যাতনের একই রকম বর্ণনা পাওয়া গেছে। যেমন একজন বন্দী বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদকারীরা আমাকে উত্তপ্ত ধাতবদণ্ডের মতো কোনো কিছুর ওপর বসান। মনে হচ্ছিল, আমাকে আগুনের ওপর বসানো হয়েছে।’ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, অপর এক বন্দীর পায়ুপথে ইলেকট্রিকের দণ্ড ঢোকানো হলে মারা যান তিনি।
ইসরায়েলের বন্দিশিবিরে অমানবিক অবস্থায় থাকার বর্ণনাও দিয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। এর মধ্যে ছিল, চোখ বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে, অন্তর্বাস ছাড়া সব পোশাক খুলে রাখা ইত্যাদি। এর আগে সামরিক ট্রাকে গাদাগাদি করে তুলে এসদে তেইমান শিবিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। পরে সেখানে তাঁদের বিশেষ ধরনের হ্যাঙ্গারে রাখা হয়। হাতকড়া পরা অবস্থায় মাদুরে চুপ করে বসে থাকতে বাধ্য করা হয় দিনে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। শ্রান্ত-ক্লান্ত বন্দীরা ঘুমের ঘরে ঢলে পড়লে কর্মকর্তারা তাঁদের ডেকে নিতেন ও শাস্তিস্বরূপ পেটাতেন।
![ফিলিস্তিনি বন্দীদের কোথাও চোখ বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে, আবার কোথাও বসিয়ে রাখতে দেখা গেছে](https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2024-01%2F9e30bf36-204f-4c53-a7dd-d11134dfecb4%2Fpalestinains_israel_2.webp?auto=format%2Ccompress&fmt=webp&format=webp&w=640&dpr=1.3)
ফিলিস্তিনি বন্দীদের কোথাও চোখ বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে, আবার কোথাও বসিয়ে রাখতে দেখা গেছে
আলাদাভাবে শুধু জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়াই ছিল এক দুঃস্বপ্নের অগ্নিপরীক্ষা। তদন্তে জানা যায়, বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এক বিশেষ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো; যেটিকে তাঁরা বলতেন ‘ডিসকো রুম’। সেখানে তাঁরা যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন, সে জন্য অতি উচ্চশব্দে বাজানো হতো গান। এ ছিল নতুন ধরনের নির্যাতন। এমন এক ঘটনায় এক বন্দীর কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে।
ডায়াপারটুকু ছাড়া বন্দীদের পুরোপুরি বিবস্ত্র করে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথাও উঠে এসেছে এ তদন্তে। তাঁদের হামাসের সদস্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করলে চলত মারধর।
![গ্রেপ্তার ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি কারাগারে নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে আসছেন](https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2024-01%2F7a30f97b-646a-4752-a487-ce93ee93d590%2Fpalestinains_israel_3.webp?auto=format%2Ccompress&fmt=webp&format=webp&w=640&dpr=1.3)
গ্রেপ্তার ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি কারাগারে নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে আসছেন
অভিযোগ নাকচ ইসরায়েলের
এসদে তেইমান বন্দিশিবিরে আটক ফিলিস্তিনিদের ‘পদ্ধতিগত উপায়ে নির্যাতনের’ এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাদের দাবি, বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হয়ে থাকে।
যাহোক সাবেক বন্দীরা নির্যাতনের যেসব বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে ছিল যথেষ্ট মিল। আর তা ছিল ইসরায়েলি সেনাদের বক্তব্যের (সাক্ষাৎকার প্রদানকারী সেনারা) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে বন্দীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানোর অস্বস্তিকর ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
![আটকের পর এভাবে ট্রাকে করে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়। গত ৮ ডিসেম্বর](https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2024-01%2F820c0d63-fb96-4496-aa3a-ef5efb9b48e8%2Fpalestinains_israel_4.webp?auto=format%2Ccompress&fmt=webp&format=webp&w=640&dpr=1.3)
আটকের পর এভাবে ট্রাকে করে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে অস্বস্তিকর ছিল, অক্টোবরের পর ওই এক শিবিরেই প্রায় চার হাজার মানুষকে বন্দী করে রাখা ও তাঁদের মধ্যে ৩৫ জনের মারা যাওয়ার বিষয়টি। এই বন্দীরা হয় শিবিরের ভেতর, নয় কাছাকাছি বেসামরিক হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা গেছেন।
এসদে তেইমান বন্দিশিবিরের এসব ঘটনা গণমাধ্যমে ক্রমেই আরও বেশি আলোচিত হচ্ছে। গত মাসে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন ওই শিবিরে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, দুর্ব্যবহারের ভয়ানক চিত্র প্রকাশ করেছিল। এ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এক আবেদনের ওপর শুনানি শুরু করেছেন ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট। এর ফলে বন্দিশিবিরটি থেকে এখন ফিলিস্তিনিদের দখল করা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী পরিচালিত কারাগারগুলোয় স্থানান্তর করা শুরু করেছে ইসরায়েল।