নির্বাচনী বছরে তিন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা আর কয়েকটি খাতের পুঞ্জীভূত সংকট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নতুন অর্থবছর। নির্বাচনী বছর হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, মোটাদাগে ত্রিমুখী চ্যলেঞ্জে পড়তে হতে পারে অর্থনীতিকে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় না থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো কঠিন হবে।
অর্থনীবিদরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে স্বল্প সময়ে এত পরিমাণ রিজার্ভ ক্ষয় ও টাকার অবমূল্যায়ন আগে কখনো দেখা যায়নি। নতুন অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে সর্বশেষ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খোয়া গেছে হাজার কোটি ডলার। এই প্রবণতা ঠেকানো কঠিন হবে নতুন অর্থবছরে। এ ছাড়া আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর তাগিদ রয়েছে। ব্যয় মেটাতে রাজস্ব আদায় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে সংকট মোকাবেলায়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনী বছরে ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ দেখছি। প্রথমত মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ, দ্বিতীয়ত সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, তৃতীয়ত শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ।
সব চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে দেখলে একটি আরেকটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, আবার কখনো তা পরস্পরবিরোধী। অর্থনীতির সম্প্রসারণ মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। আমরা যদি বেশি খরচ করি তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে।’
সায়মা হক বিদিশা আরো বলেন, ‘শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা সন্তোষজনক অবস্থায় আছি। নতুন বাজেটে আমাদের ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা আবার ৬ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্য ২৭ শতাংশ। এসব বিষয় একসঙ্গে অর্জন করা দুরূহ ব্যাপার। প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও মূল্যস্ফীতি সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখতে হবে। এটা করতে হলে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি—এই দুই নীতিকেই একভাবে কাজ করতে হবে। সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে। আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আরো বাড়াতে হবে। ডলারের বিনিময়হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এটা করলে চাপ বাড়বে, তার পরও আমাদের এদিকে যেতে হবে।’
বিদায়ি অর্থবছরে রপ্তানি-রেমিট্যান্স মিলে ৭৭৬ কোটি ডলার দেশে এলেও তা প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি চলমান বাস্তবতায়। ফলে বাড়তি চাপ থেকে যাচ্ছে নতুন বছরে। এ ছাড়া গতি আসছে না নতুন বিনিয়োগের, যা চ্যালেঞ্জে ফেলে দিতে পারে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন।
বিশ্বজুড়ে কমছে মূল্যস্ফীতি, ব্যতিক্রম বাংলাদেশ
ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলঙ্কা। মূল্যস্ফীতির হার কমে গত জুনে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতিবেশী ভারতের মূল্যস্ফীতিও দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে এসেছে। জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৪.২৫ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি কমেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একেবারেই বিপরীত অবস্থানে বাংলাদেশ। গত বছরের জুনে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.৫ শতাংশ। এরপর সেই হার ক্রমাগত বেড়েছে। চলতি বছরের জুনেও মূল্যস্ফীতির হার ৯.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ
বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রায় দুই বছর ধরে চাপে আছে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। রেকর্ড আমদানি ও বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হতে শুরু করে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত বছরের শুরুতেও দেশে প্রতি ডলারের বিনিময়হার ছিল ৮৬ টাকা। বর্তমানে আন্ত ব্যাংক লেনদেনেই প্রতি ডলার ১০৯ টাকা। এই হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। এটিও মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।
রিজার্ভ নামবে ৩০ বিলিয়ন ডলারে
চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১.১ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসতে চলেছে। আকুর বিল পরিশোধিত হবে আজ বুধবার। ৩০ জুন পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩১.১৯ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ থাকবে ৩০ বিলিয়নের কিছু বেশি।
আর্খিক খাতের সংকট
২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ তিন মাস আগের তুলনায় ৯ শতাংশ এবং আগের বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোসহ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন আমাদের প্রবৃদ্ধিতে ছাড় দিয়ে কিভাবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়, সেদিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের রিজার্ভ নিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারি সেটার দিকে বেশি নজর দিতে হবে।’
এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিস্তৃত করা, ঘাটতি অর্থায়ন, আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে সতর্কভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্প বাছাই, সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানোই নতুন অর্থবছরের চ্যালেঞ্জ। বিনিময়হার বাজারভিত্তিক করার ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। আর ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করার ফলে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এসব সামাল দেওয়া নতুন অর্থবছরের বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, ‘মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে সংকুলানমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে সংকট মোকাবেলা করতে পারব—পরিস্থিতি সেটার মধ্যে এখন আর আছে বলে মনে হয় না। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং সুশাসন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সমস্যা তিনটি। এখনো ডলার সংকট আছে। নির্বাচনী বছরের অনিশ্চয়তা আছে। বহির্বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা আছে। মূল্যস্ফীতি যদিও জুনে সামান্য কমেছে কিন্তু সেটাও গেড়ে বসেছে, যা নামতে চাইছে না। কয়েক মাস ধরেই এটা ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এখন কঠোর পদক্ষেপ না নিলে তা নামানো যাবে না। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষাও বড় চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিককালে আর্থিক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এটাকে যদি আমরা না থামাতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে।’
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি গত ছয় মাস ধরে কমে গেছে। সেই কারণে এখন আন্তর্জাতিক বাজারকে তো আর দায়ী করা যাবে না। সরকারের হাতে তিনটি করণীয় আছে। এনবিআরের হাতে আছে রাজস্বনীতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে আছে মুদ্রানীতি আর সরকারের হাতে আছে কাঠামোগত সংস্কার। বর্তমান সময়ের আলোকে কোন দিকে কিভাবে আমরা পদক্ষেপ নেব সেটার অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে।’