ফের বাড়ছে গ্যাস বিদ্যুতের দাম, মার্চ থেকে নতুন দাম কার্যকর হতে পারে
![](https://miprobashi.com/wp-content/uploads/2024/02/80faef076d20e192ce3e20b8cf4166d6-65d50016b8931-780x470.webp)
নানামুখী সংকটের মধ্যেই আবারও অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দুটি পণ্য গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী সপ্তাহে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর রোজা শুরুর আগে মার্চ থেকে নতুন দাম কার্যকর হতে পারে বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ ছাড়া মার্চ থেকে প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের নতুন দর মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই কার্যকর হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে দাম বাড়বে, আর কমে গেলে কমে আসবে। এ ছাড়া গ্যাস এবং বিদ্যুতের দামও শিগগিরই বাড়তে পারে। বিদ্যুতের দাম বেশি ব্যবহারকারী গ্রাহকদের তুলনামূলক বেশি বাড়বে। তবে গ্যাসের দাম বাড়বে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
১৪ বছরে ১৩ দফায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে অন্তত ১২১ শতাংশ। আর পাঁচ দফায় গড়ে গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ১৭৫ শতাংশ। পরিবহন খাতের সিএনজির দাম বেড়েছে ছয় দফা। সর্বশেষ গত বছর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ১৫ শতাংশ এবং ৬ শ্রেণির গ্রাহকের জন্য বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৭৯ শতাংশ, শিল্পে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়।
সরকারের উদ্যোগের কারণে ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ৫ গুণ। শতভাগ এলাকা বিদ্যুতের আওতায় এলেও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ এবং এর উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
এমন একসময়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যখন ভয়াবহ গ্যাসসংকটের পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎও পাচ্ছে না মানুষ। নিত্যপণ্যের চড়া দামে মানুষ দিশেহারা। অন্যদিকে ডলারসংকটসহ নানা কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কমে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে কাল বৃহস্পতিবার অথবা আগামী সপ্তাহের শুরুতে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। আর কার্যকর হবে মার্চ থেকে।
কী পরিমাণ বাড়বে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের মতো বাড়তে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় ৫ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ধাপে ধাপে আরও বাড়বে।
অপর একটি সূত্র জানায়, ২০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের এবার বাড়তি দাম গুনতে হবে। এর নিচে, বিশেষ করে লাইফ লাইন (৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বাড়বে না।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে ডলার ও জ্বালানি সংকটের কারণে অন্যান্য দেশের মতো আমরাও একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পিডিবির পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরও প্রতি ইউনিটে ৩ থেকে ৪ টাকা লোকসান হচ্ছে। আবার ছয়টি বিতরণ সংস্থাও এখন লোকসান করছে। এটাকে সমন্বয় করতে হলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দরকার। তবে যতটুকু বাড়ানোর দরকার তার চেয়ে কম বাড়াবে সরকার, যাতে সাধারণ মানুষের ওপর একবারে চাপ না পড়ে। সরকার এ ব্যাপারে হয়তো দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেবে।’
এর আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর একক ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। সেখানে দাম বাড়ানোর পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকম যুক্তি-তর্ক হতো। ফলে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ ছিল তুলনামূলক কম। কিন্তু গত বছর থেকে সরকার নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর জন্য আইন করে। এরপর গণশুনানি ছাড়াই গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এবারও একই কায়দায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে।
বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকের জন্য তার চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রির কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সরকারের ভর্তুকি। গত অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত পুরোপুরি ভর্তুকিমুক্ত করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে।
ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তা সত্ত্বেও সরকারি অনেক কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বেসরকারি কেন্দ্রের মালিকদের সুবিধা দিতে তাদের কাছ থেকে বেশি দামের বিদ্যুৎ কিনে সরকার এ খাতে বেশি আর্থিক ঘাটতি সৃষ্টি করছে।’
তিনি বলেন, অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় না করে বারবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এতে দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
গ্যাসেরও মূল্যবৃদ্ধি : বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। বিদ্যুতের পরই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি হবে এবং তা মার্চ থেকে কার্যকর হতে পারে বলে কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রমতে, এবার শিল্প, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সিএনজি স্টেশন ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে। তবে আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তেমন সম্ভাবনা নেই।
শিল্প উৎপাদনে মোট খরচের প্রায় ১৫ ভাগ ব্যয় হয় জ্বালানির পেছনে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের অভাবে এই ব্যয় এখন আরও বেড়েছে। নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হলে উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে গত বছর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হলেও চাহিদামতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে প্রায় ৪৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ২৬০ কোটি। ভয়াবহ গ্যাসসংকটের কারণে কারখানায় উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে এসেছে। বাসাবাড়িসহ সবখানেই চলছে অস্থিরতা।
জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় : জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়ে গেছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। আগে ডলার ৭৮ টাকায় পাওয়া যেত, এখন প্রায় ১২০ টাকার মতো হয়ে গেছে। এতে বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম অপরিবর্তিত থাকলেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দাম সমন্বয় জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যপক ড. ম তামিম বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে পেট্রোলের দাম সমন্বয় করা যেতে পারে। কিন্তু ডিজেলের ক্ষেত্রে যদি যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনের ক্ষেত্রে ভাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওঠানামার ফর্মুলা প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে ডিজেলের দাম সমন্বয় করা যেতে পারে। তা না হলে ডিজেলের দাম সমন্বয় করে লাভ নেই। কারণ ডিজেলের দাম কমলে যদি ভাড়া না কমে, তাহলে বাড়তি টাকাটা তো ব্যবসায়ীদের পকেটে যাবে। সাধারণ মানুষ এর সুবিধা পাবে না। ব্যবসায়ীদের পকেটে না গিয়ে বরং এই টাকা সরকারের কাছে থাকুক। তাতেও এই টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করতে পারবে সরকার। এতে জনগণ কোনো না কোনোভাবে এর সুবিধা পাবে।