বাজারের আগুনে জ্বলছে সংসার
কমেনি মরিচ-পেঁয়াজের ‘ঝাঁজ’ সবকিছুর দাম বাড়তি অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ
বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। একের পর এক সি-িকেট করে পণ্যে দাম বাড়ানো হচ্ছে; বাণিজ্যমন্ত্রী নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেই দায় সারছেন। মাসের পর মাস ধরে পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতি কিন্তু সে গতি থামানো যাচ্ছে না। নিত্যপণ্য ক্রয়ে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের লাখ লাখ পরিবার। অথচ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে গিয়ে কিছু ব্যবসায়ীর জরিমান করে ক্যামেরা পোজ দিয়েই দায় সারছেন।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের বেসামাল উর্ধ্বমুখি দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ। দুই শ্রেণির মানুষ আয় দিয়ে পরিবারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছেন। এতে পুষ্টির অভাব হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যঝুকি বাড়াবে। গতকাল রাজধানী ঢাকার একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে কাঁচা মরিচের আকাশছোঁয়া দামের রেশ শেষ হয়নি। এরমধ্যে আবারো বাড়তে শুরু করেছে পিয়াজের দাম। ঈদুল আজহার পর সপ্তাহ গড়ালেও প্রতিটি সবজির দাম উর্ধ্বমুখী। তাছাড়া এখনও কমেনি আদার দাম, বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থাকে ৩৬০ টাকা কেজি দরে। ভারতীয় রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজিতে, যা ঈদের আগে ছিল ১৮০ টাকা। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্র একটা করে পণ্য ধরে ধরে পকেট কাটছে ভোক্তা সাধারণ মানুষের। এভাবে দফায় দফায় বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে অনেক আগেই। নিত্যপণ্য ও সেবার দাম লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। অথচ সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাড়ানো হলেও বাড়েনি সাধারণ মানুষের আয়। অনেকেই বাধ্য হয়ে আয় ও ব্যয়ের মধ্য সমন্বয় করতে দৃশ্যত অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন সব খরচ কমিয়েছেন। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় খাবার উপকরণ কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। বাজারে পণ্যমূল্য বেশি হওয়ায় নিত্যপণ্য কিনতে না পারায় অনেক সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ লেগেই যাচ্ছে। মূলত বাজারের আগুনে সংসার জ্বলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিকে থাকতে এবং সংসারের খরচ কমাতে অনেকেই পরিবার-পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ দিকে খাবার খরচ কমানোর ফলে বাড়ছে পুষ্টিহীনতা। এতে বাড়ছে রোগ-বালাই। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছিল। এখন বিশ্ব বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমেছে। অথচ দেশের বাজারে কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। করোনার সময় থেকে প্রায় সবারই আয় কমেছে। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় থেমে থাকেনি।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন না, এমন মানুষ যেসব দেশে বেশি, সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশে এখন ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষ নিয়মিত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য তাদের পরিবারের নেই। বাংলাদেশের উপরে আছে ভারত, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও চীন। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেয়ে পুষ্টিমান অর্জন করতে একটি বড় বাধা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে না পারা।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে সকালের দিকে ব্যবসায়ীরা প্রতিকেজি কাঁচামরিচ বিক্রি করেছেন ৪০০ থেকে ৪৬০ টাকা কেজি। আর বিকাল বেলা প্রতি কেজি বিক্রি করছেন ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি’র) তথ্য বলছে, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও টমেটোসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ঈদ পরবর্তী বাজারে কাঁচা মরিচের অতিরিক্ত দামে নাজেহাল হচ্ছেন খুচরা পর্যায়ের ক্রেতারা। ভারত থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে মরিচ আমদানি করা হলেও এখনও ভোক্তা পর্যায়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের নজরদারির তোয়াক্কা না করেই এখনও অস্থিতিশীল রয়েছে কাঁচা মরিচের দাম। অপরদিকে ৪০ টাকা দরের ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। এছাড়া গত সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ ৬০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
রাজধানীর শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ পণ্যের দাম গত সপ্তাহের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। গত সপ্তাহে ২৩০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া আদা এ সপ্তাহে ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, ৬০ টাকা দরের লম্বা বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজিতে। গত সপ্তাহে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি দরে। ১২০ টাকা কেজি দরের ছোট সাইজের রসুন এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা কেজি দরে। তবে ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া বড় সাইজের রসুনের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাঝারি মানের প্রতিটি চাল কুমড়া ৫০ টাকায়, মাঝারি মানের ফুলকপি ৫০ টাকা, ঢেড়স ৪০ টাকা, উস্তা ৮০ টাকায় ও মূলা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। ফার্মের মুরগির লাল ডিম ১৪৫ টাকা ডজন, কিছুটা আকারে ছোট ডিম ১৪০ টাকা ডজন। গত সপ্তাহে সাইজভেদে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে ডিম। এছাড়া গত সপ্তাহে ফার্মের সাদা ডিম ১২৫ টাকা ডজন বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে ১৪০ টাকা ডজন বিক্রি করা হচ্ছে। তবে গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে কিছুটা কমে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, আকারে ছোট চিংড়ি গত সপ্তাহে ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি আকারের চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে। আকার ও মানভেদে চাষের পাবদা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে। তবে গত সপ্তাহে ৩০০ টাকা কেজি দরে এসব মাছ পাওয়া গেছে। রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি দরে। মাঝারি মানের চাষের পাঙ্গাস বিক্রি করা হচ্ছে ২২০ টাকা কেজি দরে। তেলাপিয়া বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা কেজি দরে। ইলিশ মাছ ১৮০০-২২০০, রুই মাছ ৪০০-৪৫০, কাতল মাছ ৪০০-৫০০, কালিবাউশ মাছ ৪০০, চিংড়ি মাছ ১০০০, কাচকি মাছ ৫০০, টেংরা মাছ ৮০০, কৈ মাছ ২৫০, শিং মাছ ৬৫০, বেলে মাছ ৯০০-১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গরুর গোশত আগের মতোই ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবি তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকায়। সেটি বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকায়। টিসিবি আমদানিকৃত প্রতি কেজি পিয়াজ ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে তা ৩৫-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। আর ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্সের তথ্য অনুসারে, প্রতি কেজি পিয়াজ ২৫ রুপিতে বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম ছিল ২০ রুপি।
শনির আখড়ায় শুক্রবারের বাজার করতে আসা মনির হোসেন বলেন, মরিচের দাম অনেক বেশি। দু’দিন আগে এক পোয়া কিনেছি ৬০ টাকায়। আজকে (গতকাল শুক্রবার) বলছে এক পোয়া ১৪০ টাকা। এটা কীভাবে সম্ভব! দেশটা কি মগের মুল্লুক? সরকার এদিকে খেয়ালই করছে না?
ঢাকা বারের সদস্য অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান বলেন, শুক্রবার বাজারে এলেই ঘাম ছুটে যায়। প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনতে পারি না। সব জিনিসের অতিরিক্ত দাম। সবকিছুর দাম বাড়লেও আমার আয় তো বাড়েনি। দেশি মাছ খাওয়া এখন বিলাসিতা। কিছুই বলার নেই। দাম বাড়ে আর আমরা কিনে খাই। এভাবেই চলছে। কিছুই ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই।
কাঁচা মরিচ বিক্রেতা মো. ফারুক খান বলেন, পাইকারি বাজারে আমরা অতিরিক্ত দামে মরিচ কিনে এনেছি। ৩২০ টাকায় মরিচ কিনতে হলে ভাড়া এবং সব খরচ মিলে ৩৫০ টাকায় বিক্রি তো হবেই। কখনও কখনও লোকসান হলেও আমরা ৩০০ টাকায় মরিচ বিক্রি করছি। দাম বাড়লে আমাদের সাথে কথা বলে লাভ নেই। আড়ৎদারদের সিন্ডিকেটেই সব হয়।
শুক্রবার সাপ্তাহিক বাজার করতে আসা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা সবাই দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, খরচের সঙ্গে আয়ের ভারসাম্য না থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, চাল, ডাল, মাছ, গোশত, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সংসারে অভাব ছাড়ছেই না। অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে যাদের আয় কম তারাই সবচেয়ে কষ্টে আছেন। এমনকি কুলিয়ে উঠতে না পারায় কেউ কেউ পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন।