বেনাপোল স্থলবন্দরে ‘ডিজিটাল’ কারসাজি করে রাজস্ব ফাঁকি
- জালিয়াতিতে জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যে ১০ কর্মকর্তা–কর্মচারীকে বদলি।
- এই স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে ৭-৮ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি।
- প্রতারকেরা ওজন স্কেলে কাঙ্ক্ষিত ওজন না পেলে অ্যাডমিন আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ওজন পরিবর্তন করে দিত।
যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের ওজন স্কেলে (ওজন পরিমাপক যন্ত্র) কারসাজি করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে একটি চক্র। ওজন স্কেলের জন্য ব্যবহৃত সফটওয়্যারের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই আমদানিকারকদের ভারত থেকে পণ্য আনার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
এ কাজে বন্দরের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। জালিয়াতিতে জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যে ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করেছে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে এ ঘটনায় ছয়টি তদন্ত কমিটি করা হলেও ছয় মাসেও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, দেশে স্থলবন্দর আছে ২৪টি। এর মধ্যে বেনাপোল দিয়ে সবচেয়ে বেশি ৬০-৭০ শতাংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। দেশের বৃহত্তম এই স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে ৭-৮ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করা হয়। গত অর্থবছরে বন্দর থেকে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করেছে সরকার। বন্দর ও কাস্টমস-সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্যএকটি সূত্র জানিয়েছে, শুধু গত অর্থবছরেই ওজন কারসাজির মাধ্যমে প্রতারকেরা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
সফটওয়্যারের ত্রুটি কাজে লাগিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইডি-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে প্রায় তিন বছর ধরে কারসাজি করে আসছিল চক্রটি।
সফটওয়্যারে ত্রুটি থাকার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে বন্দরের সার্ভারে ঢুকে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ত্রুটি কাজে লাগিয়ে ওজন জালিয়াতি করেছে একটি চক্র। তাঁরা ইতিমধ্যে সফটওয়্যারের ত্রুটি দূর করার ব্যবস্থা নিয়েছেন।
কিন্তু ত্রুটি এখনো রয়ে গেছে। আমদানি পণ্যের ওজন কারসাজির বিষয়ে সফটওয়্যারটি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বন্দর ও তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ওজন স্কেলের কাজ
ওজন স্কেল ৩০ ফুট দীর্ঘ একটি লোহার সেতু। এর নিচে যন্ত্র থাকে। ওজন স্কেলের সঙ্গে কম্পিউটার সংযুক্ত থাকে। পাশের একটি ঘরে কম্পিউটারে ট্রাকসহ আমদানি পণ্যের ওজন পরিমাপ করা হয়। বেনাপোল স্থলবন্দরে ওজন স্কেল আছে সাতটি। এর মধ্যে ২ ও ৩ নম্বর ওজন স্কেল নষ্ট হয়ে আছে। ১ ও ৭ নম্বর ওজন স্কেল জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওজন স্কেলে ট্রাকসহ আমদানি করা পণ্য ওজন করা হয়।
ভারত থেকে আসা পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্গো গেট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রথমে আমদানি-রপ্তানি কার্গো শাখায় সফটওয়্যারে ট্রাকটি এন্ট্রি নিয়ে সরাসরি বাইপাস সড়কে ৪ ও ৫ নম্বর ওজন স্কেলে ওজনের জন্য চলে যায়। ওজন দেওয়ার পর ট্রাকগুলো টিটিআই (ট্রাক টার্মিনাল অব ইন্ডিয়া) মাঠে চলে যায়। এরপর পোস্টিং শাখা থেকে ট্রাকগুলোকে পোস্টিং দেওয়া হয়। সে অনুয়ায়ী ট্রাকগুলো স্থলবন্দরের নির্ধারিত ছাউনিতে গিয়ে পণ্য খালাস করে ভারতে ফিরে যায়।
পচনশীল পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডের ৬ নম্বর ওজন স্কেলে ওজন দিয়ে ইয়ার্ডে অবস্থান করে। পরে ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড থেকে ভারতীয় ট্রাক থেকে পণ্য বাংলাদেশি ট্রাকে তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়া হয়।
যেভাবে জালিয়াতি
বেনাপোল স্থলবন্দরে গতি আনতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্দর অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণসহ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় আড়াই কোটি টাকা।কাজটি পায় রাজধানীর বেসরকারি সফটওয়্যার কোম্পানি ‘ডাটা সফট’। ওজন স্কেলে আসা পণ্যবাহী ট্রাক বা লরির ওজন পরিমাপের পর গাড়ির ওজন বাদ দিয়ে পণ্যের ওজন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্ভারে সংরক্ষণ করে সফটওয়্যারটি। পাশাপাশি শুল্ক হিসাবের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেনাপোল কাস্টমস ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু নথিতে দেখা যায়, বন্দরে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরপরই কিছু ত্রুটি খুঁজে পায় স্থলবন্দর ও কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সমন্বয়ে তৈরি একটি চক্র।
আমদানি-রপ্তানি কার্গো গেট দিয়ে একটি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশের পরপরই ওই চক্রের সদস্যরা ঘোষণাকৃত পণ্য ও ট্রাকের ওজন জেনে যেত। ঘোষণা–বহির্ভূত পণ্যের হিসাব লুকাতে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিত। কখনো ট্রাকের পেছনের অংশ ওজন স্কেলের বাইরে রাখা হতো। এতে পণ্যের ওজন অনেক কমে যেত। আবার কখনো ভারত থেকে আসা ট্রাকের সমপরিমাণ ওজনের একটি ট্রাক ওজন স্কেলে দাঁড় করিয়ে দিত। পরে ঘোষণাপত্রের সঙ্গে মিল রেখে পণ্যের ওজন দেখাত তারা। এভাবে বাড়তি পণ্যের শুল্ক ফাঁকি দিত। এ কাজ করতে গিয়ে চক্রের সদস্যরা সংশোধিত তথ্যসংবলিত একাধিক রসিদ তৈরি করত।
কম্পিউটারাইজড স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েও কারসাজি হতো। এ ব্যাপারে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটিতে থাকা একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রতারকেরা ওজন স্কেলে কাঙ্ক্ষিত ওজন না পেলে অ্যাডমিন আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ওজন পরিবর্তন করে দিত। বিষয়টি যাতে ধরা না পড়ে, সে জন্য সফটওয়্যারের রেকর্ড থেকে পুরোনো তথ্য মুছে দিত। অ্যাডমিন আইডি থাকা ব্যক্তিরা দূর থেকে ‘অ্যানি ডেস্ক’ সফটওয়্যারের মাধ্যমে এ কাজ করত। তিনি বলেন, সফটওয়্যারটির সাধারণ সুরক্ষার বেশ কিছু ত্রুটি আছে। সফটওয়্যারটি স্বতন্ত্র একটি সার্ভার দিয়ে চালানো হয়, যেটি বড় ত্রুটি। এখন সফটওয়্যারটির ডেটাবেজ লগ না থাকায় মুছে দেওয়া বা পরিবর্তন করা তথ্য খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
সব তথ্য মুছে ফেলত
গত ১২ জুলাই ৫ নম্বর ওজন স্কেলে বহিরাগত একজনকে দেখতে পায় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই ওজন স্কেলের দায়িত্বে ছিলেন বন্দরের ট্রাফিক পরিদর্শক জাবেদী বিল্লা। বহিরাগত ওই ব্যক্তি জাবেদীর আইডি ব্যবহার করছিলেন। ওই দিন স্থলবন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) বরাবর একটি অভিযোগ করেন জাবেদী বিল্লা। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, কিছুদিন ধরে কে বা কারা তাঁর আইডি ব্যবহার করে অবৈধ কাজ করছে। তবে বন্দর সূত্র জানায়, নিজেকে বাঁচাতে জেনেবুঝে অভিযোগ করেছেন জাবেদী বিল্লা।
এ ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) আক্তার উননেছা শিউলিকে প্রধান করে ১৬ জুলাই পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১৪ আগস্ট প্রতিবেদন জমা দেয়। আক্তার উননেছা শিউলি বলেন, প্রতারকেরা সফটওয়্যার থেকে তাঁদের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট মুছে ফেলেছে। এ জন্য কে, কখন, কোথায় কারচুপি করেছে, শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁরা একটি ওজন স্কেলে কারসাজির প্রমাণ পেয়েছেন। সফটওয়্যারে ত্রুটি ছিল। ডাটা সফটের প্রকল্প সমন্বয়ককে প্রত্যাহার করতে বলেছেন। পণ্যের ওজনের রসিদে কোনো রকম সংশোধনী রাখা যাবে না বলে সুপারিশ করেছেন তাঁরা।
৬ তদন্ত কমিটি
বেনাপোল স্থলবন্দরে এমন জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর মোট ৬টি তদন্ত কমিটি করা হয়। এর মধ্যে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি একটি। বাকি ৫টি তদন্ত কমিটি কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের।
তদন্ত কমিটি আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, অপারেটর, সুপারভাইজার ও সফটওয়্যারে প্রবেশাধিকার ছিল, এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপর তদন্ত করেছে। ইতিমধ্যে কমিটি স্থলবন্দরের সহকারী প্রোগ্রামার মো. হোসেন আলী, ট্রাফিক পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম, জাবেদী বিল্লা, আব্দুল কাদের জিলানী, মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ও ওয়্যারহাউস সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমানসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, বন্দর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, বিল্লাল হোসেন ও আনোয়ারুল ইসলাম নামে দুজন বহিরাগত ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওজন স্কেল পরিচালনা করেছেন। ওজনে কারসাজির সময় বন্দরের সব ওজন স্কেল পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন উপপরিচালক (ট্রাফিক) মনিরুল ইসলাম। অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
বন্দর সূত্র জানায়, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রোগ্রামার হোসেন আলী ও ডাটা সফট প্রকল্প সমন্বয়ক শাহাদাত হোসেনের আইডি ব্যবহার করে ওজনে কারসাজি করা হয়। হোসেন আলী নিজেই তদন্ত কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে বদলির আগে বেনাপোল বন্দরের একমাত্র আইটি বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। ঘটনা প্রকাশের পর ডাটা সফটের শাহাদাতকে প্রত্যাহার করা হয়।
সফটওয়্যারটি সংশোধন ও কনফিগার করতে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার আব্দুল হাকিম বলেন, যেকোনো সফটওয়্যারের আদর্শ বৈশিষ্ট্য, কোনো তথ্য সার্ভারে সংরক্ষিত হলে তা মুছে দেওয়া যায় না। সিস্টেমে ত্রুটি থাকলে আইটি বিশেষজ্ঞরা সংরক্ষিত তথ্য থেকে তা শনাক্ত করতে পারেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে পারেন। বেনাপোল বন্দরের সফটওয়্যারে তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।