Bangladesh

মাঠের শক্তি ভোটে কাবু

ইসলামপন্থি দলগুলোর মিছিল-সমাবেশে নেতাকর্মীদের যথেষ্ট উপস্থিতি দেখা যায়। জোট করে জাতীয় নির্বাচনে আসনও পেয়েছে। বড় দলের সঙ্গে জোট করে একাধিক আসন পাওয়ারও নজির আছে। কিন্তু নির্বাচন রাজনীতিতেও তারা পিছিয়ে পড়ছে।

১৯৯০ সালে ছয়টি ইসলামপন্থি দল ইসলামী ঐক্যজোট নামে জোট করে। এই জোটে ছিল খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমান ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ফরায়েজী আন্দোলন। সেই জোট এখন নেই। দলগুলোতে ভাঙন হয়েছে। জোটের নামেই একটি দল এখন সক্রিয়।

ইসলামী ঐক্যজোট প্রথম নির্বাচন করে ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে। একসময় জোটটি বিএনপির সঙ্গেও বৃহত্তর জোট করে। কিন্তু গত তিন দশকের বেশি সময় পরে এসে তাদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া আর কারও ভোট তেমনভাবে বাড়েনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসলামি দলগুলোর কখনো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি, পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু নির্বাচনী সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়। ক্ষমতার সঙ্গেও থাকে। ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিও দেশে শক্ত অবস্থা তৈরি করতে পারেনি। পারলে জামায়াত ইসলামী ভেঙে নতুন দল তৈরি হতো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বেপারি বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার অভাব ও রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতা না থাকায় ভোটের মাঠে ইসলামি দলগুলো সুবিধা করতে পারছে না। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি ও জনসম্পৃক্ত ইস্যুগুলোতে সরব না হলে, সামনে তাদের ভোট আরও কমতে পারে।’

বিএনপির সঙ্গে থাকলে ইসলামি দলগুলো বেশি সুবিধা পায় মন্তব্য করে এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘বিএনপি ছাড় দেয় বেশি। বিএনপির ওপর প্রভাব বিস্তারও তারা বেশি করে। যেটা আওয়ামী লীগের সঙ্গে পারে না।’

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ইসলামি দলগুলোর উন্নতি ও নির্বাচনে তাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘নব্বইয়ের দশক থেকে ইসলামপন্থি দলের সংখ্যা বেড়েছে। অন্য যেকোনো মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মতোই বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতির বিভিন্ন ধারা উপস্থিত ছিল এবং আছে। সংসদ নির্বাচন যদি সব দলের অংশগ্রহণমূলক হয়, তবে প্রধান দল বা জোটের কাছে ইসলামপন্থি দলগুলো গুরুত্ব পাবে, সেই গুরুত্ব ভোটারদের মধ্যে তাদের সমর্থনের অনুপাতের চেয়ে অনেক বেশিই হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রধান জোটগুলো তাদের ইসলামি পরিচিতিকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্যই এ ধরনের দলের দ্বারস্থ হবে।’

নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২০০৮ সাল রাজনৈতিক দল নিবন্ধন দেওয়া শুরু করে। বর্তমানে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাকের পার্টি ইসলামপন্থি হিসেবে পরিচিত।

ইসির তথ্য বলছে, দেশের ইসলামি দলগুলো এককভাবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার নজির নেই বললেই চলে। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে তারা বড় দলগুলোর সঙ্গে জোট করে সংসদে আসার পথ তৈরি করেছে। যদিও এসব দলের ভোট দিন দিন কমছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ছয়দলীয় ইসলামী ঐক্যজোট প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৫১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। মিনার প্রতীকে নির্বাচন করে একটি আসন পায় তারা। ভোট পেয়েছিল ২ লাখ ৬৯ হাজারেরও বেশি। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ১৬৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রায় ৪ লাখ ৬১ হাজার ভোট পেলেও আসন পায় একটি। জোটে ভাঙন ধরে। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে ছিল। ওই সময় তারা মিনার ও ধানের শীষ প্রতীকে চারটি আসন পায়। শাহীনুর পাশা চৌধুরী ও ফজলুল হক আমিনী ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন। মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস ও মো. শহীদুল ইসলাম মিনার প্রতীকে নির্বাচন করেন। চারজন মিলে ভোট পান ৩ লাখ ৬৭ হাজার ১৯৫টি। ওই সময় জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন ইসলামী জাতীয় ফ্রন্টে ছিল ইসলামী আন্দোলন।

নবম সংসদ নির্বাচনের আগে নেতাদের মধ্যে মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে ইসলামী ঐক্যজোট ভেঙে যায়। মুফতি আমিনীর নেতৃত্বাধীন ঐক্যজোট মিনার প্রতীক নিয়ে বিএনপির চারদলীয় জোট থেকে নির্বাচন করে। তবে কোনো আসন পায়নি। বিএনপির সঙ্গে ২০-দলীয় জোটে থাকায় ইসলামী ঐক্যজোটও ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। ২০১৬ সালে আবার ভেঙে যায়। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা কোনো আসন পায়নি। ভোট পায় ১১ হাজার ৩২৮টি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোট দলীয়ভাবে নির্বাচন করে সারা দেশে ৪২ আসনে প্রার্থী দেয়। ভোট পেয়েছে ৬৮ হাজার ২৬৪।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের আবুল হাসনাত আমিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে নির্বাচন করে পান ৯৯৪ ভোট। যুগ্ম মহাসচিব আলতাফ হোসাইন কুমিল্লা-২ আসনে পেয়েছেন ৯৪৪ ভোট। আরেক যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ তৈয়্যেব হোসাইন ময়মনসিংহ-২ আসনে ১ হাজার ৭৫৩ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।

ইসলামী ঐক্যজোট ছাড়াও অন্য ইসলামি দলগুলোর একজন প্রার্থীও জয়ী হতে পারেননি। এমনকি দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানেও আসতে পারেননি। যদিও সংসদ নির্বাচনে দলগুলো মিলে ২৪৫ জন প্রার্থী দিয়েছিল। এর মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের প্রার্থী ছিল ৩৮, ইসলামী ঐক্যজোটের ৪২, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ৩৭, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের ১১, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের ৩৮ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির ৭৯ জন।

২০০১ সালের নির্বাচনে ১৭টি আসন পেয়েছিল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ভোট ছিল ২৩ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬১টি। প্রায় ৪.২৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টও ৩০ হাজার ৭৬১টি ভোট পেয়েছিল।

২০১৮ সালে এসে একক দল হিসেবে রাজনীতিতে ঝড় দেখানো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৩ ভোট পায়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট পায় ৬০ হাজার ৩৭২ ভোট। ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ পায় ৩১ হাজার ৪৬৮ ভোট। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পায় যথাক্রমে ৯ হাজার ৭৯৬ ও ২ হাজার ৩৫১ ভোট। খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস পায় যথাক্রমে ১১ হাজার ২০৩ ও ২ হাজার ৮৯৯ ভোট।

ইসলামপন্থি আরেকটি পুরনো দল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ২০০১ সালের নির্বাচনে ১৩ হাজার ৪৭২ ভোট পেলেও ২০১৮ সালে পায় ৯ হাজার ৭৯৬ ভোট। আর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এসে ১১ জন নেতাকে নিয়ে ভোট করে। দলটির ছয়জন প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ৭ হাজার ৯১০ ভোট। আরেকটি দল বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এমএ মতিন চট্টগ্রাম-১২ আসনে মোমবাতি প্রতীকে ৮ হাজার ২৯৮ ভোট পান। একই অবস্থা চট্টগ্রাম-১৪ আসনে দলটির মহাসচিব সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আবদুস সামাদের। তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ২৩১ ভোট। দলটির নয়জন প্রার্থীর ভোট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তারা সবাই মিলে পেয়েছেন ৯ হাজার ৬১২ ভোট।

ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশর মহাসচিব আবুল বাশার মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন জুবাইর চেয়ার প্রতীকে চট্টগ্রাম-১০ আসনে নির্বাচন করে পেয়েছেন ৫৬৫ ভোট। এ আসনে মোট ভোট পড়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ১৩৪। চট্টগ্রাম-১১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি পান ২ হাজার ১৫১ ভোট। দলটির বাকি ১০ জন প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ১২ হাজার ৮৮০ ভোট।

নির্বাচনের দুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে সরে দাঁড়ান তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) ফুলের মালা প্রতীকে তিনি পান ২৩১ ভোট। ওই আসনে ভোট পড়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৬৫টি। তার বাকি ১৯ জন প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ৯ হাজার ৫৩১ ভোট।

আরেকটি দল খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে বটগাছ প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ৬৩৫ ভোট। দলটির কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে ৪৭৩ আর সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা সুলতান মহিউদ্দিন কুমিল্লা-২ আসনে ২২২ ভোট পেয়েছেন। পুরনো আরেক দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের তিন প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ৩ হাজার ৪১ ভোট।

এর বাইরে ইসলামপন্থি দলের নেতাদের মধ্যে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য শাহীনুর পাশা চৌধুরী ভোট পেয়েছেন ৪ হাজার ৯৫টি। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহসভাপতি ছিলেন। গত ২৩ নভেম্বর নির্বাচন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে তৃণমূল বিএনপির হয়ে লড়েন তিনি।

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এমএ মতিন বলেন, ‘অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যে পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়, সেটি ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে নেই। কর্মী থেকে নেতা হওয়ার যে অভিজ্ঞতা, সেটার অভাব ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে প্রকট। কেননা এখন যারা নেতা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই মাদ্রাসা বা দরবার থেকে উঠে আসা। ফলে রাজনৈতিক কর্মী থেকে নেতা হওয়ার প্রবণতা কম।’

হঠাৎ বড় নেতা হতে চাওয়ার কথা জানিয়ে মতিন বলেন, ‘নেতা হওয়ার লোভের কারণেই ধর্মীয় দলগুলোতে বিভক্তি চরম। এতে দলগুলোও সামনে এগোতে পারছে না। একই সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রপন্থার চেতনা ইসলামি দলগুলো প্রাধান্য দিচ্ছে, যা সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। ফলে ভোটের হিসাবে দিন দিন গরমিল হচ্ছে।’

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইসলামি দলগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ সুনির্দিষ্ট নয়, লক্ষ্য উদ্দেশ্যবিহীন এবং কর্মপরিকল্পনা অগোছালো। আবার যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা দিতে চান, ভোটের মাঠে তাদের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো বড় দলগুলোর রাজনৈতিক শিকড় অনেক গভীরে এবং এসব দলের অধিকাংশ নেতারই সামাজিক অবস্থান অনেক সুসংহত। এ ছাড়া ইসলামি দলগুলোর নানা বিতর্কিত, অন্তর্ঘাত ও আপসমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিফলনই নির্বাচনগুলোতে ঘটছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button