মিটার রিডারদের হাতে বিলের ‘ চোরা চাবি’
কখনও বাণিজ্যিক ভবন হয়ে যাচ্ছে আবাসিক, কখনও ভবন নির্মাণের তথ্য হচ্ছে গুপ্ত। আবার কেউ মিটার খুলে রেখে পানির বিল কমিয়ে দেওয়ার ধান্দায় ব্যস্ত। গভীর নলকূপের তথ্য লুকাতে কেউ হয়ে ওঠেন ‘গভীর জলের মাছ’। ওয়াসার পানি ব্যবহারে এমন ছলাকলায় খোদ মিটার রিডাররাই অতিশয় দক্ষ। পানির বিল নিয়ে রকমারি কাণ্ড করে ফায়দা লুটছেন ওয়াসার এসব অসাধু বিলিং সহকারী; করছেন নিজের পকেট ভারী।
ওয়াসার পানিকাণ্ডে কালেভদ্রে দুয়েকজন শাস্তির মুখোমুখি হলেও অনেকে ছড়ি ঘুরিয়েই যাচ্ছেন। ভবন মালিক, মিটার রিডারদের তদারককারী সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও), রাজস্ব কর্মকর্তা এবং ওয়াসার দুয়েকজন অসাধু বড় কর্তাও এমন অনিয়মের সঙ্গী।
এসব কারসাজির দাঁড়ি টানতে তিন মাস অন্তর মিটার রিডারদের এলাকা বদলের নির্দেশনা থাকলেও অনেকে বছরের পর বছর খুঁটি গেড়েছেন। ফলে পানির বিল নিয়ে অনিয়মের বল্গা ছুটছেই। অবশ্য ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্নীতির ব্যাপারে শূন্য সহনশীল নীতি নিয়েছে তারা। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা।
এদিকে, এ ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে গত ১১ মার্চ ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৪ ও ১০-এ (মিরপুর এলাকা) অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানকালে গত তিন মাসে বিচ্ছিন্ন করা সংযোগ ও নতুন সংযোগ দেওয়া হোল্ডিংয়ের তালিকা সংগ্রহ করে দলটি। এ ঘটনায় দেলোয়ার নামে এক বিলিং সহকারীকেও বরখাস্ত করে ঢাকা ওয়াসা।
তিন বছর পর ভবনে মিটার রাজধানীর ভাটারার একটি আবাসিক এলাকার জে ব্লকের ১১ নম্বর রোডের ৩৪৭ নম্বর প্লটে ৯ তলা আধুনিক ভবনটির কাজ শেষ হয়েছে বছরখানেক আগে। ভবনে বসবাস শুরু হয়েছে মাস ছয়েক হলো। এর আগে ভবন তৈরিতে সময় লেগেছে আরও তিন বছর। ঢাকা ওয়াসার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ভবনের নির্মাণকাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পানির বিল হবে বাণিজ্যিক হারে। তবে এ ভবনের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি। প্রায় সাড়ে তিন বছর ভবনটির বিপরীতে ওয়াসা পানির বিলই ইস্যু করেনি। গত নভেম্বরে প্রথম দেওয়া হয় বিল। এর আগের পানির বিল করা হয়েছে গায়েব। ভবন মালিক ও ওয়াসার মিটার রিডার যোগসাজশে এ কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায় ঢাকা ওয়াসা।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ঢাকা ওয়াসা ওই ভবনে পানির মিটার দেয় ২০২২ সালের ১ আগস্ট। মিটারটি চালু হয় ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর। শুরু থেকেই এটির ক্যাটেগরি আবাসিক। ৯ তলা ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত পানি কোথা থেকে এলো– এ ব্যাপারে বাড়ির মালিক মোকসেদুর রহমান বলেন, ‘ওয়াসার সব বিষয়ে দেখার দায়িত্ব একজনকে দেওয়া হয়েছিল। সে-ই সব করেছে। কীভাবে করেছে, আমি জানি না।’
ভবনটিতে পানির মিটার লাগানো এবং বিল ইস্যুর দায়িত্বে থাকা মিটার রিডার আসিফ আহমেদ বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় যারা বাড়ি নির্মাণ করে, তারা ওয়াসাকে না জানিয়েই গভীর নলকূপ বসিয়ে ফেলে। যখন ওয়াসা জানতে পারে, তখন মিটার লাগিয়ে দেওয়া হয়। আগে যতদিন পানি ব্যবহার করছে, এর একটি গড় বিল ধরা হয়।’
দেখা যায়, গত জানুয়ারিতে ভবনটির পানির বিল হয়েছে ১ হাজার ৬৬৪ টাকা। ৯ তলা ভবনের পানির বিল কীভাবে এত কম হলো– এ প্রসঙ্গে আসিফ আহমেদ বলেন, ‘গভীর নলকূপের পানির বিল অর্ধেক। এ ছাড়া ওখানে স্যুয়ারেজ লাইন নেই। এ জন্য বিল কম এসেছে।’
বিল গায়েব
একই চাতুরী ওই আবাসিক এলাকার আই ব্লকের ৬ নম্বর রোডের ৩০৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের বেলায়ও। এ ভবনের মিটার অনুমোদন হয় ২০২২ সালের ৭ আগস্ট, আর বিল ইস্যু শুরু হয় গত ৩১ অক্টোবর। ভবনটির ব্যবহার শুরু বছরদুয়েক আগে। এটিরও নির্মাণ সময়ের বিল করা হয়নি। আই ব্লকের আরও দুটি প্লটে (৭ নম্বর রোডের ২৪৮ ও ৮ নম্বর রোডের ২৫১) গড়ে ওঠা ভবনে একই ঘটনা ঘটেছে। দুটি প্লট এক করে ৯ তলা বাড়ি তৈরি হয়েছে বেশ আগেই। সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনটির প্রতি তলাতে আছে বাসিন্দা। ওয়াসার বিলে ভবন মালিকের নাম এম খালেদ মোহাম্মদ তারেক। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের একজন লোক ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করে পানির অনুমোদন নিয়েছে। সে-ই সবকিছু দেখেছে। তবে পানির বিল নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’
গত জানুয়ারিতে বিশাল ভবনটির পানির বিল আসে মাত্র ১ হাজার ৮০৪ টাকা। আর ৩০৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের (মিটার নম্বর ০৮০২৮২৩৬৮০) পানির বিল আসে ১ হাজার ৭১৪ টাকা। বিষয়টি ঢাকা ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল মজুমদারের নজরে আনা হলে তিনি প্রতিটি অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। পরে তিনি ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম রায়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
একই রকম ভবন, দুই রকম বিল
ভাটারার মাদানী অ্যাভিনিউর ২৪৭৫ দাগে সাড়ে ১৬ কাঠা জমিতে গড়ে ওঠা একটি বাণিজ্যিক ১০ তলা ভবনের গত ফেব্রুয়ারির পানির বিল (মিটার নম্বর ০৮০২৫৭৬২০০) করা হয় মাত্র ৪ হাজার ২০০ টাকা। ভবনে আছে দোকান, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিশাল ভবনের এত কম পানির বিল প্রসঙ্গে মালিক বশির আহমেদ বলেন, ‘কেন কম বিল হয়, তা বলতে পারব না। তবে ওয়াসার বিরুদ্ধে বেশি বিল করার যে অভিযোগ নগরবাসী করে বলে শোনা যায়, আমার এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই।’
মাদানী অ্যাভিনিউ এলাকায় পানির বিল করেন বিলিং সহকারী আহমেদ সাদী। তিনি বলেন, ‘রিডিং যদি ঠিক থাকে, তাহলে বিলও ঠিক আছে। যা বিল এসেছে সেটাই করেছি।’
ওই ভবনের পাশেই ৫১ মাদানী অ্যাভিনিউয়ে একই রকম (দাগ নম্বর ২৪৭৫, ৯৭০৭, ৯৭০৮) আরেকটি দশ তলা বাণিজ্যিক ভবনের বিপরীতে গত জানুয়ারিতে বিল (মিটার নম্বর ০৮০২৮২২৭০৭৪) আসে ১ লাখ ৯১ হাজার ৩০৪ টাকা। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একই রকমের ভবনের কোনোটির বিল আসছে প্রায় ২ লাখ। আরেকটি আসছে মাত্র ৪ হাজার। এটা কীভাবে হলো– সে প্রসঙ্গে মিটার রিডার আহমেদ সাদী বলেন, ‘কাগজপত্র না দেখে বলা যাবে না। আর এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলাও নিষেধ আছে।’
বাণিজ্যিক ভবনের আবাসিক বিল
এদিকে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরিবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউর ১৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে গড়ে ওঠা একটি বেসরকারি হাসপাতালের শুরুতে বাণিজ্যিক বিল ইস্যু হলেও পরে সেটাকে আবাসিকে রূপান্তর করা হয়। আবাসিকে পরিণত করার জন্য দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে সই করেন রাজস্ব পরিদর্শক হাবিবুর রহমান ও ফিল্ড অফিসার (এখন রাজস্ব পরিদর্শক) এনায়েত করিম। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আবাসিক বিল ইস্যু হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ প্লটে হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে।
এ ব্যাপারে এনায়েত করিমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। বর্তমানে হাসপাতালটির বিল ইস্যুর দায়িত্বে আছেন মিটার রিডার শামছুদ্দিন শিকদার। এর আগে বিল করতেন সুজা উদ্দৌলা (অবসর)। এর আগে ছিলেন টিপু সুলতান। ওই এলাকার মিটার রিডারদের কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. ফেরদৌসের। তিনি বলেন, ‘এ রকম হওয়ার কথা না। যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে তারাই খুঁজে বের করবে কোনটিতে কী ধরনের কার্যক্রম চলছে। আমি নিজেও এ এলাকার দায়িত্বে নতুন এসেছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। বাণিজ্যিক কার্যক্রম চললে অবশ্যই শ্রেণি পরিবর্তন করা হবে। মিটার রিডার শামছুদ্দিন শিকদার বলেন, ‘গত মাসে আমি এ এলাকার দায়িত্ব পেয়েছি। বিষয়টির আমি খোঁজ নেব।’
গভীর নলকূপের সংখ্যা গোপন
রাজধানীতে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা গভীর নলকূপ স্থাপনের সংখ্যা লুকোচুরি করে যাচ্ছে। যার চারটি আছে তিনি দুটির তথ্য লুকাচ্ছেন। কারও তিনটি থাকলে দুটির তথ্য গোপন করছেন। অথচ গোপন করা গভীর নলকূপের পানিও ব্যবহার করছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। যেমন– রাজধানীর কদমতলী থানার সামনে শ্যামপুর শিল্প এলাকার ২১ নম্বর সড়কের ৩২ নম্বর প্লটে অবস্থিত রানী রি-রোলিং মিলে তিনটি গভীর নলকূপ আছে। তবে বিল হয় দুটির; একটির তথ্য গোপন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার মিটার রিডাররা প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে যোগসাজশে এ অনিয়ম করছেন বলে সমকালের তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
গত ১১ মার্চ সরেজমিন রানী রি-রোলিং মিলে গেলে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মী আটকে দেন। পরে মোবাইল ফোনে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) জুয়েল রানা বলেন, কয়টি গভীর নলকূপ আছে, আমার জানা নেই।
একই কায়দায় শ্যামপুরের কামাল রি-রোলিং মিলে চারটি গভীর নলকূপ বসানো আছে; বিল হয় দুটির। সালাম রি-রোলিং মিলের দুটি নলকূপের একটির বিল হয় না। এনামুল ডাইংয়ের দুটির একটি অবৈধ। মারুফ ডায়িংয়ের দুটির মধ্যে একটির বিল হয় না।
কী বলছে ওয়াসা
এসব বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের সাক্ষাৎ চাইলে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে বিস্তারিত শোনেন। পরে তিনি ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম রায়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
উত্তম রায়ের দপ্তরে গিয়ে অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত দিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে ফোন করে এগুলোর বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘বিলিং সহকারীরা যে এক-আধটু এদিক-সেদিক করে না, তা বলব না। তবে এসব ঘটনায় ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসা শূন্য সহনশীল নীতি নিয়েছে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় এ ধরনের অভিযোগে একজনকে চাকরিচ্যুতির আদেশ দেখিয়ে বলেন, ‘একটু পরই এ বরখাস্ত আদেশ জারি হবে। আরও দু’জনের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ তৈরি হচ্ছে।’