International

যুদ্ধের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে ছাড়িয়ে গেছে রুশ প্রবৃদ্ধি

রাশিয়ার অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির হার ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ উভয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়ার উপরে ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং প্রধান বিশ্ব বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার অর্থনীতি ৩.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

তবে, প্রবৃদ্ধির বেশিরভাগ সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ার ফলে হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। রাশিয়া প্রায় দুই বছর আগে ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করার পর থেকে তা অব্যাহত রেখেছে। ফলে, এই প্রবৃদ্ধি টেকসই কিনা এবং এর কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সব বিষয়ে কিছু অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলছেন।

রাশিয়ার ফেডারেল স্টেট স্ট্যাটিস্টিকস সার্ভিস রোসস্ট্যাট বুধবার প্রবৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, যা ২০২২ সালের বিপরীত। রাশিয়ার জিডিপি ২০২২ সালে ১.২ শতাংশ কমে যায়। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর একটি জোট ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের জন্য শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা হিসেবে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যিনি মার্চে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন, তিনি বলেছেন, তার দেশের অর্থনীতি সফলভাবে পশ্চিমা বাজার থেকে সরে আসছে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা বাড়াচ্ছে এবং একই সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

সামরিক উৎপাদনে অর্থনীতি চাঙ্গা

রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৪ সালেও অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এর গতি কিছুটা হ্রাস পাব। রাশিয়ার জিডিপি ২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে যে পূর্বাভাস দেশের সরকার দিয়েছে, তা কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের প্রকাশিত ২.৬ শতাংশ পূর্বাভাসের চেয়ে কম।

র‍্যান্ড কর্পোরেশনের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ হাওয়ার্ড জে. শাটজ ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উৎস চিহ্নিত করা কঠিন নয়।

শাটজ বলেন, ‘রাশিয়ার প্রবৃদ্ধির পেছনে যে কারণটি বহুলাংশে কাজ করছে তা হচ্ছে সেখানে ব্যাপক আর্থিক প্রণোদনা দেয়টা হচ্ছে।’

শাটজের মতে, ২০২৩ সালে রাশিয়ার সরকার প্রায় ৩৫৩.৮ বিলিয়ন ডলার (৩২.৪ ট্রিলিয়ন রুবল) ব্যয় করেছে যা ২০২২ সালে ব্যয় করা ৩১ ট্রিলিয়ন রুবলের চেয়ে বেশি। তবে এইসব সংখ্যা যুদ্ধপূর্ব ব্যয়ের মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়ায় ২০২১ সালে ফেডারেল বাজেট ছিল মাত্র ২৭০ বিলিয়ন ডলার (২৪.৮ ট্রিলিয়ন রুবেল)।

‘তারা প্রতিরক্ষা শিল্পকে সমর্থন করছে। তারা কর্মসংস্থানে উৎসাহিত করছে। তারা সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদানের জন্য জনগণকে বোনাস দিচ্ছে,’ শাটজ বলেন। ‘তারা নিহত সেনা সদস্যদের পরিবারকে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। তারা আহত সেনা সদস্যদের বেতন দিচ্ছেন, কিছু ভাগ্যবান যাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’

ক্রেমলিন কর বৃদ্ধি, জাতীয় সম্পদ তহবিল থেকে খরচ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থ বাজার থেকে ধার নেয়ার মাধ্যমে ঐসব ক্ষেত্রের ব্যয় অর্থায়ন করা হয়েছেprsaf। ঐতিহাসিকভাবে সরকারে ঘাটতি এখন বেশি যা মোট বাজেটের প্রায় ১০ শতাংশ।

‘এটা কতটুকু টেকসই? এটা সত্যিই সুস্পষ্ট নয়,’ শাটজ বলেন। ‘আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেতিবাচক সাড়া প্রত্যক্ষ করেছি, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখছে ওইসব ব্যয় যা তারা মূল্যস্ফীতির চাপ হিসেবে দেখছে।’

প্রণোদনার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৪ শতাংশ যা ২০২২ সালের ১১.৯ শতাংশ থেকে কম। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ঠেকাতে সুদের হার বাড়িয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ২০২২ সালের গোড়ার দিকে একাধিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছিল যার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার ক্ষমতাকে দুর্বল করা এবং যাতে করে সাধারণ রাশিয়ানরা ক্রেমলিন যা করছে তার বিরূপ প্রভাবগুলো অনুভব করে।

পশ্চিমা দেশের অনেক বাজার থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা ছাড়াও, ওই পদক্ষেপগুলো নেয়ার ফলে রাশিয়ান ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষমতাকে তীব্রভাবে সীমাবদ্ধ করেছিল। তেল ও গ্যাসের বাণিজ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত রাশিয়ান তেলের মূল্যের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

নিষেধাজ্ঞা আরোপের শুরু থেকেই, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা সময়ের সাথে সাথে হ্রাস পেতে পারে, কারণ যে দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তারা অন্যান্য দেশের সাথে নতুন বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করবে। উদাহরণ স্বরূপ, ইউরোপে রাশিয়া তাদের বাণিজ্য হারানোর পরে তার অনেকটাই পুষিয়ে নিয়েছে চীনের সাথে তাদের বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ সপ্তাহে, স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক অধিবেশনে বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাদজা লাহবিব বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকতে থাকতে আরেকটি নিষেধাজ্ঞা সংযোজন করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে, যা হবে ২০২২ সালের পর থেকে ১৩তম নিষেধাজ্ঞা।

বেশিরভাগ রাশিয়ান, বিশেষ করে যারা বড় শহরগুলোতে বাস করেন তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় নয়, বলছেন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইউরোপ, রাশিয়া ও ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো মারিয়া স্নেগোভায়া।

মূল্যস্ফীতি উচ্চমাত্রায় রয়েছে, তবে শ্রমিকদের উচ্চ বেতনের কারণে তা পুষিয়ে যাচ্ছে, যেহেতু বেকারত্বের হার এখন ঐতিহাসিকভাবে প্রায় সর্বনিম্ন পর্যায়।

মারিয়া বলেন, ‘দেখে মনে হয়, অন্তত বড় শহরগুলোতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবেই চলছে,’ ভয়েস অফ আমেরিকাকে স্নেগোভায়া বলেন। ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা আছে, যেমন একটা ধারনা আছে যে দেশটি সঠিক পথে এগুচ্ছে না। তবে এর বাইরে তেমন কোনো আমূল পরিবর্তন কিন্তু হয়নি।’

তিনি জানান, ‘এখনো মানুষের কাজ আছে।[পশ্চিমা] পণ্যের স্থান দখল করে নিয়েছে চীনা পণ্য … এবং তারা নিষেধাজ্ঞা এড়ানোরও নানা উপায়ও খুঁজে বের করে। সুতরাং, এমন নয় যে সেখানে জিনিসপত্রের ব্যপক ঘাটতি রয়েছে।’

তার মতে, ‘এখনকার মতো এটা কাজ করছে। তবে এটা কেন কাজ করছে এবং তা কতক্ষণ স্থায়ী হবে, সে সম্পর্কে কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।’

তিনি বলেন, প্রধান প্রধান শহরের বাইরের অঞ্চলগুলোর পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। তিনি এই উদ্ধৃতি দেন, রাশিয়ার জনগণ যারা ওই অঞ্চলগুলোতে বাস করে তাদের সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতে।

মারিয়া জানান, ‘এটা আমার ধারণা যে পরিস্থিতি আরো খারাপ, এই অর্থে যে তারা বিশেষ বিশেষ জিনিষপত্রের সরবরাহ ঠিক মত পাচ্ছে না, জিনিসপত্রের ঘাটতি অনুভব করে। পণ্য সরবরাহের একটা বড় অংশ স্পষ্টতই বড় শহরগুলোতে চলে যাচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই, এই খেলায় কেউ কেউ হারবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button