যৌতুক দাবি কিংবা মারধরের অভিযোগে করা মামলায় অভিযোগ বেশি সাজা কম
![](https://miprobashi.com/wp-content/uploads/2023/10/saja.jpg)
মিরপুর কমার্স কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দুই শিক্ষার্থী ভালোবেসে বিয়ে করেন ২০১৬ সালের ২৯ এপ্রিল। কিন্তু বিয়ের পর থেকে স্বামী-স্ত্রী ও দুই পরিবারে টানাপড়েন শুরু হয়। ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য মারধর ও গলা টিপে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন স্ত্রী। আসামিকে কয়েক দিন কারাগারে থাকতে হয়। বিচার শেষে ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ আসামিকে খালাস দেয়।
এ মামলার আগে একই বাদী একই ব্যক্তিকে আসামি করে যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায় আরেকটি মামলা করেছিলেন ২০১৮ সালের ২০ মার্চ। ঢাকার সংশ্লিষ্ট আদালত ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর রায়ে আসামিকে খালাস দেয়।
প্রথম মামলার রায়ে বলা হয়, সাক্ষীরা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি। ভুক্তভোগী জখমের কথা বললেও হাসপাতালে ভর্তির কোনো মেডিকেল সনদ দেখাতে পারেননি। দ্বিতীয় মামলার রায়েও বলা হয়, সাক্ষ্য ও অন্য নথিপত্রে বাদীপক্ষের অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
অথচ দুই মামলায় বিচার পেতে পাঁচ বছরের বেশি সময় আদালতে ঘুরতে হয়েছে বাদী, আসামি ও তাদের স্বজনদের। মামলার জের ও তিক্ততায় ইতিমধ্যে দুজনের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।
যৌতুক দাবি কিংবা মারধরের অভিযোগে করা মামলায় দিনের পর দিন আদালতে ঘোরেন বাদী, আসামি ও তাদের স্বজনরা। কিন্তু অন্যান্য মামলার মতো এসব মামলায়ও বিচার পেতে ভুগতে হয় তাদের। অকাট্য সাক্ষ্য ও প্রমাণের অভাবে অনেক আসামি খালাস পান। অনেকে সংসার ও সন্তানের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় আপস করেন। সাজা হয় অল্প কিছু ক্ষেত্রে।
সার্বিক বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘মামলা বেশি হলেও কেন বেশি খালাস কিংবা আপস হচ্ছে সেটি প্রশ্ন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো আসামি সাক্ষী রেখে স্ত্রীকে মারধর করে না। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহী আইনজীবী, তৃতীয়পক্ষ ও বাদীর ইচ্ছাতে স্বামীর পরিবারের অনেককে আসামি করা হয়। ফলে বিচারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মামলা দুর্বল হয়। আসল ভুক্তভোগী ভোগান্তিতে পড়েন।’
সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) এবং যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায় সারা দেশে ২২ হাজার ২৭৭টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) এ দুই আইনে মামলা হয়েছে ৯ হাজার ১১৪টি। মাত্র ১১ মাসে যৌতুক চাওয়া, মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগে ৩১ হাজার ৩৯১টি মামলা আদালতে গড়িয়েছে। অর্থাৎ দুই আইনের ধারায় গড়ে প্রতি মাসে ২ হাজার ৮৫৩টির বেশি মামলা হয়েছে।
ঢাকার অধস্তন আদালতে বাদী ও আসামিপক্ষে এ সংক্রান্ত মামলা পরিচালনাকারী অন্তত সাতজন আইনজীবীসহ নারী অধিকারকর্মী ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেছে । বেশ কিছু মামলার নথিও পর্যালোচনা করা হয়েছে। আইনজীবীদের ভাষ্য, গত কয়েক বছরে যৌতুকের জন্য মারধর ও নির্যাতনের মামলা অনেক বেড়েছে। নিষ্পত্তির হারও আগের চেয়ে বেড়েছে অনেক। বিপরীতে দুপক্ষের আপসও বেড়েছে।
আইনজীবীরা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে মামলায় মূল আসামির বাইরে সংশ্লিষ্টতা নেই এমন লোকদেরও আসামি করা হয়। তদন্তের ত্রুটি থাকে। শুনানিতে ভুক্তভোগী, সাক্ষী ও ঘটনার পারিপাশির্^ক অবস্থার গরমিল থাকে। সাক্ষ্য ও তথ্যপ্রমাণের ঘাটতি থাকে। একই বাদীর একই আসামির বিরুদ্ধে দুই ধারায় দুই মামলা করার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে আইনজীবীদের মধ্যে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝির কারণেও মামলা হয়। স্ত্রীপক্ষের স্বজনরা সবসময় যে ভালো ভূমিকা পালন করে, এমন নয়। অন্যদিকে যারা আসলে ভুক্তভোগী নন, তাদের মধ্যে প্রতিপক্ষকে দেখে নেওয়ার মতো প্রতিহিংসা কাজ করে। নারী শিশু আইনে জামিন হয় না এমন ধারণা থেকেও অনেকে এ আইনে মামলা করেন। এসব কারণে মামলা প্রচুর বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক নারী সংসার টেকাতে চায়। হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ভালো দিক হলো আপসে অনেক সংসার টিকে যাচ্ছে। আর খারাপ দিক হলো অনেক মামলা নিয়ে আদালতের অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে সত্যিকারের ভুক্তভোগীরা বিচার পাচ্ছেন না।’
আইনে যা আছে : দুই ধরনের আইনে যৌতুক চাওয়া ও এর জন্য শারীরিক মানসিক নির্যাতনের বিচারের বিধান রয়েছে। যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, বিয়ের কোনো একপক্ষ বিয়ের আগে বা পরে অন্য কোনো পক্ষের কাছে যৌতুক দাবি করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর ও অন্যূন এক বছর কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড হবে। এই আইনে অপরাধকে আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য ও আপসযোগ্য করা হয়েছে। এ অভিযোগে বিচার চলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারা অনুযায়ী, কোনো নারীর স্বামী কিংবা তার পরিবারের কেউ যৌতুকের জন্য কোনো নারীকে জখম করলে দোষী ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিন বছর ও অন্যূন এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। এ আইনের মামলার বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। জামিন অযোগ্য এ ধারাটি ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল হাইকোর্টের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এখন আপসযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে দুই আইনেই কারও ক্ষতির উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগে মামলা করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারায় যৌতুকের জন্য কোনো নারীর মৃত্যু ঘটালে মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে।
আপস ও খালাস বেশি : যৌতুকসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি, সাজা, খালাস কিংবা আপস নিয়ে আইন ও বিচারসংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি। তবে আইনজীবীরা মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, দুই আইনের মামলায় সাজার হার কম। আপস ও খালাসের ঘটনা বেশি হয়। মামলাও দীর্ঘায়িত হয়। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, সাক্ষীর গরহাজিরা, বক্তব্যের অসংগতি, মেডিকেলের যথাযথ নথি দাখিল করতে না পারা ও প্রমাণের অভাব।
ফরিদপুরের এক দম্পতির বিয়ে হয়েছিল প্রায় দুই যুগ আগে। তাদের কোনো সন্তান নেই। কর্মসূত্রে দুজনই ইতালি থাকেন। ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ওই নারী মামলা করেন স্বামীর বিরুদ্ধে। মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ। ২০২০ সালের জুনে বাদী সাক্ষ্য দিয়ে ইতালিতে ফিরে যান। যুক্তিতর্কের তারিখ পড়লেও মামলাটি এখনো অনিষ্পন্ন। এ মামলায় বাদীকে আইনি সহায়তা দেওয়া আইনজীবী (পেশাগত কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘আসামি আরেকটি বিয়ে করেছেন। সন্তানও আছে। এতকিছুর পরও বাদী আপস চান। কিন্তু আসামিপক্ষ তা চান না। শুধু শুনানির তারিখ পড়ছে।’
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক ব্যক্তি ১৭ বছর আগে বিয়ে করেন। এই দম্পতি মোহাম্মদপুরে সংসার শুরু করেন। এক যুগ সংসার করার পর নানা টানাপড়েনে ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌতুকের মামলা করেন স্ত্রী। এ মামলার বিচারকাজ চলছে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এ। ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ইতিমধ্যে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হলেও সাক্ষীর গরহাজিরায় মামলাটি এখনো অনিষ্পন্ন। বাবা-মায়ের দ্বন্দ্বে তাদের দুই ছেলে সন্তান বিপাকে পড়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বাদীপক্ষকে আপসের প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু বাদীপক্ষের তাতে উৎসাহ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, ‘সাক্ষী না আসা কিংবা সাজা কম হওয়ার কারণ হলো, কিছু মানুষ শুধু হয়রানির জন্যই মামলা করেন। যৌতুক নিরোধ আইনের চেয়ে তাদের বেশি আগ্রহ নারী শিশু আইনের মামলায়। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণ করতে বেগ পেতে হয়। যেহেতু আপসের ঘটনা বেশি ঘটছে, সংগত কারণে অব্যাহতি কিংবা খালাস বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটা মামলা হবে। কিন্তু দেখতে পাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে দুই আইনের দুই ধারায় মামলা হচ্ছে। এতে মামলাজট, সম্পর্কের তিক্ততা ও বিচারপ্রার্থীর হয়রানি বাড়ছে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকে মামলার মাঝপর্যায়ে এসে আপসের জন্য ব্যতিব্যস্ত হন। কারণ তারা ভোগান্তি ছাড়াও মামলা নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন। অভিযোগ যদি প্রমাণ করতেই হয়, তাহলে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ নিয়েই মামলা করা সমীচীন।’