শতাধিক অ্যাপে প্রতারণার ফাঁদ: লোভনীয় অফারে অনেকেই নিঃস্ব, ছড়িয়েছে গ্রাম পর্যন্ত
‘মারফিন-ইনভেস্টমেন্ট ডট ওআরজি’ নামে একটি অ্যাপ মাত্র ১০ দিনেই বিনিয়োগের টাকা দ্বিগুণ করে দেওয়ার অফার দেয়। ‘মোবিক্রিপ’ নামে আরেকটি অ্যাপে বিনিয়োগের টাকা ২৫ মাসে ২৫০ শতাংশ করে দিবে বলে প্রলোভন দিয়েছে। এ ছাড়াও টিএনএস অ্যান্ড বরগাটা, ফিনটচ, প্লাটিন কয়েন, প্লাটিন আই-এক্স, ক্রাউড ওয়ান, হিলটন মেটা টিআর এবং থাইল্যান্ড ভিত্তিক মুভি প্ল্যান ডট নেটসহ এমন শত শত অ্যাপ বাজারে অফার ছড়াচ্ছে। এসব অ্যাপের ফাঁদে পড়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন।
ওইসব অ্যাপের ওয়েবসাইটে দেওয়া থাকছে দুবাই, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা কিংবা অন্য কোনো দেশের ঠিকানা। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সুযোগ নিয়ে এখন চলছে অনলাইনে এসব প্রতারণা। সম্প্রতি অনলাইন অ্যাপ ‘এমটিএফই’ অভিনব কায়দায় মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। অফিস কিংবা মালিককে না দেখেও শুধু শুনে এখানে বিনিয়োগ করেছিলেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ‘মারফিন-ইনভেস্টমেন্ট ডট ওআরজি’ নামে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে মোট পাঁচটি বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পরিকল্পনায় বিনিয়োগ করা যাবে সর্বোচ্চ ৩০০ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৩ হাজার টাকা। মাত্র ২৪ ঘণ্টা বা এক দিনেই ১৫ শতাংশ লাভ দেওয়ার প্রস্তাব। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় ২ দিনে ৩০ শতাংশ লাভ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করা যাবে ৫০০ থেকে ১ হাজার ৪৯৯ ডলার। ওয়েবসাইটিতে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের।
মারফিন ছাড়াও বাজারে জাল বিস্তার করছে ‘মোবিক্রিপ’ নামে আরেক কোম্পানি। এদের প্রস্তাব রয়েছে ২৫ মাসে বিনিয়োগকৃত অর্থ ২৫০ শতাংশ করে দেওয়ার। অর্থাৎ ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে তা আড়াই লাখ হয়ে যাবে এই সময়ে। এই কোম্পানিতে কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারলে মিলবে ১০ শতাংশ কমিশন। আরও বেশি গ্রাহক আনতে পারলে মোটা অঙ্কের কমিশনের সঙ্গে পাওয়া যাবে বেশ কিছু বোনাস। ‘ফিনটচ’ নামে আরেক অ্যাপের প্রস্তাব প্রতিদিনের। তাদের কাছে কেউ ১ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন লাভ মিলবে কমপক্ষে ১৪ ডলার বা ১ হাজার ৬০০ টাকা। এই কোম্পানির আবার রয়েছে নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি। শুরুতে প্রতিটি কয়েনের দাম উঠেছিল কয়েক হাজার ডলার। তবে বর্তমানে কমতে কমতে চলে এসেছে ৫০ ডলারের ঘরে। তাতে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন তাদের বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে ইতোমধ্যে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ এ প্রতিবেদককে বলেন, নানা ধরনের অ্যাপসে প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে এলে আমরা তা বিটিআরসিকে অবহিত করি। পরে তারা তা বন্ধ করে দেয়। গত ২-৩ বছরে বিটিআরসি এমন প্রায় ৫ শতাধিক অ্যাপস বন্ধ করেছে। আর্থিক প্রতারণা সংক্রান্ত অ্যাপসগুলোর মধ্যে ইনভেস্টমেন্ট, লোন এবং গেমলিং আছে। এগুলো অবৈধ আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি নজরদারি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আর অ্যাপস বন্ধ বলে দেওয়ার দায়িত্ব বিটিআরসির। আমরা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করি। এদিকে ‘অনলাইনে দিনে ২০ মিনিট কাজ করে মাসে ১৮ হাজার টাকা আয় করুন’, ‘কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ দিচ্ছি আমরা’ এমন চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে বহু মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করছে চীনা নাগরিকেরা। এর বাইরেও অনলাইনে নানাভাবে বাংলাদেশিদের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করছেন তারা। সাইবার অপরাধের বেশ কয়েকটি মামলা তদন্ত করে বাংলাদেশে অবস্থানরত চীনা নাগরিকদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ।
অ্যাপসে প্রতারণার ঘটনায় আটটি মামলার পাঁচটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। আর তিনটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। এসব মামলায় বিভিন্ন সময়ে চীনের ৭ নাগরিকসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত শেষে দুটি মামলার চার্জশিটও দিয়েছে ডিবি। তাতে তিন চীনা নাগরিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাকি তিনটি মামলার তদন্ত চলছে।
গত ১৯ জানুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেন আবু তালহা নামে এক যুবক। তার মামলায় চীনা নাগরিক কেভিন চেন, ইম্মানুয়েল এডায়ার্ড গোমেজ, জেরি পলিকাপ রোজারিও, বুরহান উদ্দিন, শহীদুল ইসলাম, শাহীনুর আলম রাজীব, শাহ আলম, ইমতিয়াজ, আকরাম আলী, শফিক, আরিফুজ্জামান এবং এস এম আবু সায়েমকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
আবু তালহা জানান, তিনি টিএনএস অ্যান্ড বরগাটা সফটওয়্যারটি তার মোবাইলে ইনস্টল করেন। ওই অ্যাপ থেকে তার আয়ের প্রতিদিন ১০০ টাকা করে ৪ দিনে মোট ৪০০ টাকা তার বিকাশ অ্যাকাউন্টে যোগ হয়। এরপর তাকে মেসেজ দিয়ে বলা হয়- স্থায়ী সদস্য হতে হলে ১০ হাজার টাকা ইনভেস্ট করতে হবে। এরপর দৈনিক ৮০০ থেকে ৫ হাজার টাকা আয়ের প্রলোভন দেখানো হয়। তিনি গত বছরের অক্টোবরে একটি বিকাশ নম্বরে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। স্থায়ী সদস্য হওয়ার পর ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা করে প্রতিদিন আয় করতেন। আরও বেশি আয়ের আশায় একপর্যায়ে তিনি ১ লাখ ৭ হাজার টাকা ডিপোজিট করেন। তিনি ছাড়াও তার বন্ধু তানভীর ৯৬ হাজার টাকা এবং সাদেক ৪০ হাজার টাকা ডিপোজিট করেন। এরপর গত ৮ ডিসেম্বর অ্যাপসটির সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।