Hot

শীত উত্তরে, কম্বল চট্টগ্রাম-কুমিল্লায়

  • দিনাজপুরে দরিদ্র মানুষ সাড়ে ২১ লাখ, কম্বল বরাদ্দ ৪৪ হাজার।
  • চট্টগ্রামে দরিদ্র মানুষ প্রায় সাড়ে ১২ লাখ, কম্বল গেছে ১ লাখ ৩৪ হাজার।
  • গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও জামালপুরে তুলনামূলক কম কম্বল বরাদ্দ।

চলতি মৌসুমে দেশজুড়েই তীব্র শীত। বেশি বিপর্যস্ত দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলা। তুলনামূলক দরিদ্রও বেশি ওই এলাকায়। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কম্বল বরাদ্দের চিত্রে দেখা যায়, সেখানেই কম্বল গেছে কম।

বিপরীতে তুলনামূলক কম শীত ও কম দরিদ্র থাকা কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলায় বেশি কম্বল গেছে। যদিও অধিদপ্তরের নির্দেশিকাতেই আছে, শীতপ্রধান এলাকার শীতার্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরা কম্বল পাবেন। অগ্রাধিকার পাবেন দরিদ্ররাও।

শীতার্ত ব্যক্তিদের জন্য চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেশের ৬৪ জেলায় ৩৩ লাখের কাছাকাছি কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে গেছে ২৮ লাখের মতো এবং অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ৫ লাখের কাছাকাছি। এসব কম্বল জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বণ্টন করা হচ্ছে। এর মধ্যে শীতপ্রবণ ২৫টি জেলায় গেছে সোয়া ১২ লাখ কম্বল। আর তুলনামূলকভাবে শীত কম এবং কম দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাগুলোর জন্য দেওয়া হয়েছে ২০ লাখের বেশি।

রংপুরে  শীত বেড়েই চলেছে। সাইকেলে চড়ে কাজে যাচ্ছেন একদল দিনমজুর

রংপুরে শীত বেড়েই চলেছে। সাইকেলে চড়ে কাজে যাচ্ছেন একদল দিনমজুরফাইল


২০২০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে প্রকাশ করা বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে (পোভার্টি ম্যাপস অব বাংলাদেশ) দেখা যায়, দিনাজপুরে ৬৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র; যা সংখ্যায় প্রায় সাড়ে ২১ লাখ। আবহাওয়া দপ্তরের হিসাব বলছে, চলতি জানুয়ারিতে উত্তরাঞ্চলের এই জেলায় ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১০ দিন শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। এই জেলায় চলতি শীত মৌসুমে সরকার কম্বল বরাদ্দ করেছে ৪৪ হাজারের মতো।

বিবিএস ও ডব্লিউএফপির তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিনাজপুরের প্রায় অর্ধেক, ১২ লাখ ৫৬ হাজার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের গত পাঁচ বছরের তথ্য বলছে, চট্টগ্রামে এ সময়ে কোনো শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। অথচ এ জেলায় কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দিনাজপুরের ৩ গুণ বেশি, ১ লাখ ৩৪ হাজারের মতো।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, তাঁরা দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ৫২০টি করে কম্বল দেন। এর বাইরে এলাকাভিত্তিক চাহিদা বিবেচনায় রেখে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘সচেতনভাবে কোনো এলাকায় বেশি বা কম কম্বল দেওয়া হয় না। কোনো জেলা চাহিদা পাঠালে সেখানে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে। কারণ, আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে কম্বল আছে।’

শীতপ্রবণ ২৫টি জেলায় গেছে সোয়া ১২ লাখ কম্বল। আর তুলনামূলকভাবে শীত কম এবং কম দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাগুলোর জন্য দেওয়া হয়েছে ২০ লাখের বেশি।


দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কম্বল বরাদ্দের জেলাওয়ারি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম ছাড়াও এক লাখের বেশি করে কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কুমিল্লা, ঢাকা ও গাজীপুর জেলায়। আর দেশের দারিদ্র্যের হারে শীর্ষে থাকা কুড়িগ্রাম জেলায় ৮৪ হাজার, শৈত্যপ্রবাহপ্রবণ সিলেটে ৮৫ হাজারের বেশি কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী জেলা ৬৯ হাজার, রংপুরে প্রায় ৬৭ হাজার, পাবনায় ৭১ হাজার, বরিশালে ৭৫ হাজার, নরসিংদী জেলায় দেওয়া হয়েছে ৭৩ হাজার কম্বল।

বিবিএস ও ডব্লিউএফপির বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও গাজীপুরকে উচ্চ আয়ের জেলা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই তিন জেলায় গত পাঁচ বছরে কোনো শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। এ বছরও দেশের ২১ জেলায় যখন শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে, তখনো এসব জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। মানে, শীত তুলনামূলক কম ছিল।

সচেতনভাবে কোনো এলাকায় বেশি বা কম কম্বল দেওয়া হয় না। কোনো জেলা চাহিদা পাঠালে সেখানে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে। যথেষ্ট কম্বল আছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান

শীত বেশি, কম্বল কম যেসব জেলায়

মেহেরপুর, গাইবান্ধা, বান্দরবান, ঝালকাঠি, নড়াইল, জয়পুরহাট, খাগড়াছড়ি, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট, বরগুনা, পঞ্চগড় ও জামালপুরে তুলনামূলক কম কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে এসব জেলার বেশির ভাগই শীতপ্রবণ। বেশির ভাগই দেশের দরিদ্রতম জেলার মধ্যে পড়ে।

চলতি মাসে এ পর্যন্ত পঞ্চগড়ে সাত দিন এবং চুয়াডাঙ্গায় ছয় দিন শৈত্যপ্রবাহ ছিল। দারিদ্র্য মানচিত্রে বান্দরবান দেশের তৃতীয়, গাইবান্ধা অষ্টম ও লালমনিরহাট দশম।

পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, জেলায় গতকাল ভোরে ঘন কুয়াশা থাকলেও দুপুরে ছিল বেশ রোদ। গায়ে শার্ট আর লুঙ্গি পড়ে ভুট্টাখেতে নিড়ানি দিতে লাঙল টানছিলেন সুলতান আলী (৩০) ও মমতাজুল ইসলাম (৪২)। শীতের বিষয়ে মমতাজুল করলেন, ‘এত বড় ঠান্ডাখান যাছে বাহে এইবার হামাক কেহো একটা কম্বল দিলে নাই। হামার (আমাদের) গুচ্ছগ্রামোত (আশ্রয়ণ প্রকল্প) প্রায় ১২০টি পরিবার আছে। কাহাও এইবার কম্বল পায়নি। ঠান্ডাখানোত কাহাও একবার খোঁজও নিলে নাই।’

জেলার শীতার্ত ব্যক্তিদের মধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে ৩৩ হাজার ৫০০টি কম্বল বিতরণের কথা জানিয়েছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ সরকারিভাবে মাত্র ২০০ কম্বল বরাদ্দ পেয়েছে। তার মধ্যে আমি মেম্বার হিসেবে ১২ টা কম্বল বরাদ্দ পেয়েছি। আমার ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা এক হাজার ৯০৩ জন। এর মধ্যে কম্বল পাওয়ার মতো ৮০০ থেকে এক হাজার গরীব লোক আছেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই কম্বলের জন্য মানুষ বাড়িতে আসে। চাহিদার  তুলনায় আমরা খুব কম কম্বল পাওয়ায় মানুষকে আশ্বাসও দিতে পারছি না।’

তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, বুধবার সকাল ৯টায় তেঁতুলিয়ায় সারা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টানা প্রায় একমাস ধরে জেলায় তীব্র শীত চলছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মতো কম্বল বিতরণের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক বৈষম্য ও বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে আমলে নিতে হবে। নয়তো যে জনগোষ্ঠীর জন্য ওই সহায়তা সরকার দিতে চাচ্ছে, তারা বঞ্চিত হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button