‘সিদ্ধান্ত গ্রহণ’ নারীর অধিকারে নেই
ছেলের আশায় গর্ভধারণ করলে তৃতীয় সন্তানও মেয়ে হয় শেরপুরের বাসিন্দা রেহানার। স্বামী মনসুরের ধারণা, স্ত্রীর কারণেই ছেলের বাবা হতে পারছে না সে। যে কারণে স্বামীর স্বপ্ন পূরণে চতুর্থ সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এবারও আলট্রাসনোগ্রামে ধরা পড়ে– গর্ভের সন্তান মেয়ে। চাপ প্রয়োগ করে গর্ভপাতে বাধ্য করে সে। শেরপুর শহরের একটি নার্সিং হোমে গর্ভপাত করাতে গিয়ে প্রাণ যায় রেহানার।
তাঁর বাবা জয়নাল আবেদীন বলেন, গর্ভপাত না করানোর অনুরোধ করলে তাঁর মেয়ের ওপর নির্যাতন শুরু করে মনসুর। বারবার জোর করে সন্তান নষ্ট করানো হতো। মৃত্যুর পর রেহানাকে ফেলে পালিয়ে যায় স্বামী মনসুর। মেয়ের অকাল মৃত্যুতে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘মনসুর আমার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলেছে।’
শুধু রেহানাই নন; বিয়ে থেকে শুরু করে সন্তান নেওয়া বা গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত এখনও নারী নিতে পারেন না। যদিও এটি নারীকে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত এবং মারাত্মক শারীরিক ক্ষতির মুখোমুখি করে। কখনও কখনও জীবন দিতে হয়। এ অবস্থায় আজ শুক্রবার সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশে এ বছরের প্রতিপাদ্য– ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ; এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ।’ দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আশার কথা, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উচ্চশিক্ষিত, শহুরে, শ্রম ও পেশাজীবী নারীদের মধ্যে অধিকার নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। তারা এখন পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখছেন। নিজের আয়ের বড় একটি অংশ পছন্দমতো ব্যয় করতে পারছেন। যদিও সামগ্রিকভাবে এ হার খুব বেশি নয়।
আবার শুধু নিম্নবিত্তই নয়, সব শ্রেণির নারী নানাভাবে পরিবারের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য হন। বিয়ের কিছুদিন পরই যৌতুকের দাবিতে চাপ প্রয়োগ শুরু হয় সুমির ওপর। ঢাকার উচ্চশিক্ষিত এই নারী জানান, ছয় বছরের প্রেমের বিয়ে। বিয়ের কিছুদিন পর যৌতুকের জন্য শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর হাতে তিনি প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতেন।
তিনি বলেন, নানাভাবে আমার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হতো, যেহেতু আমি চাকরি করতাম। মাঝে মাঝে আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে দেওয়া হতো।
পরিবারে নারীদের ক্ষমতায়ন এখনও নেই। দেশের সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, ৮৫ শতাংশ পরিবার পুরুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। শুধু ১৫ শতাংশ পরিবারের নেতৃত্বে আছেন নারী। এই তথ্য যখন পরিবারের মধ্যেই নারী নেতৃত্বের ভারসাম্যহীনতা তুলে ধরে, তখন সমগ্র দেশের প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অবস্থান আরও নড়বড়ে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি বলেন, বাংলাদেশে কোনো না কোনো কাজের মাধ্যমে ৬৫ শতাংশ নারী আয় করছেন। কিন্তু এর মধ্যে ১০ শতাংশ আয়ের অর্থ কীভাবে ব্যয় করবেন, তা জানেন না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অন্যতম বাধা এটি। এ ছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। সম্পদে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নারীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সম্পদে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে– গোপন রাখতে দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি একটি নীতিমালা তৈরি করে হাইকোর্টে জমা দিয়েছে। জন্মের আগে গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে, তা নিয়ে উদ্বেগে থাকে অনেক পরিবার। দেখা যায়, লিঙ্গ পরিচয় জানতে আলট্রাসনোগ্রাম করানোর সময় মেয়ে সন্তান হবে– এমনটা জানলে অনেক পরিবারের সদস্যই আশাহত হন। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা শ্বশুরবাড়িতে শারীরিক, মানসিকসহ নানা ধরনের অত্যাচারের শিকার হন। এই নীতিমালা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। এ নীতিমালার উদ্দেশ্য– গর্ভাবস্থার যে কোনো সময়ে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণে প্রি-নেটাল ডায়াগনসিস টেস্টের অপব্যবহার রোধ এবং ভ্রূণের লিঙ্গ নির্বাচনের জন্য প্রজনন চিকিৎসার অপব্যবহার রোধে সচেতনতা তৈরি করা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বলেন, শুধু নীতিমালা হলেই হবে না। আইনে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। যিনি জিজ্ঞেস করবেন এবং যিনি বলবেন– উভয়ের জন্যই শাস্তির বিধান থাকতে হবে।
নারী দিবস উপলক্ষে আজ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র আলাদাভাবে শোভাযাত্রা, সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে– উদ্যোক্তা মেলা, পাঁচজন নারীকে বিশেষ সম্মাননা এবং ১০ ছাত্রীকে ‘লীলা নাগ স্মারক বৃত্তি’ প্রদান।