Bangladesh

হুঙ্কারে কাঁপছে দেশ: ২৮ অক্টোবর নিয়ে রাজনীতিতে চরম উত্তেজনা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে লগি-বৈঠার তা-ব এবং লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্যের অমানবিক দৃশ্য চোখে ভাসছে, দেশি-বিদেশি সবাই আতঙ্কিত

২৮ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে চরম উত্তেজনা। হুঙ্কার, পাল্টা হুঙ্কারে কাঁপছে দেশ। ওই দিন মাঠের বিরোধী দলসহ এক দফা দাবির আন্দোলনের সমমনা দলগুলো মহাসমাবেশ ডেকেছে। বিএনপির মহাসচিব ঘোষণা দিয়েছেন ‘ওই দিন জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ে আন্দোলনের মহাযাত্রা শুরু হবে’। বিএনপি মহাসচিবের এ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পাল্টা ঘোষণা দিয়েছে, ‘ওই দিন তাদেরও মহাযাত্রা শুরু হবে, বিএনপি ঢাকা অবরোধের চেষ্টা করলে পাল্টা আওয়ামী লীগও অবরোধ করবে, বিরোধী দলকে বসতেই দেয়া হবে না।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় (তাদের ভাষায়) তারাও প্রস্তুত।

আসন্ন ওই দিনের ঢাকায় কর্মসূচির উত্তেজনা রাজধানী ছেড়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি দিনটিতে কী ঘটে তা দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো সজাগ দৃষ্টি রাখছে। গতকাল আওয়ামী লীগের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ‘শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ’ করবে আওয়ামী লীগ। ২৮ অক্টোবর নিয়ে হুংকার পাল্টা হুংকার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের শঙ্কা প্রকাশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকষ্ঠা শুরু হয়ে গেছে। সবার মধ্যে শঙ্কা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির রাজপথ দখলের হুঙ্কারের পরিণতি কি ঘটবে? কারণ ২৮ অক্টোবর তারিখটি দেশের মানুষের জন্য এক হৃদয়বিদারক কলঙ্কিত ইতিহাসের দিন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দেশের রাজনীতির ইতিহাসে রক্তাক্ত এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। ২০০৬ সালের সেই দিন লগি-বৈঠার তা-বের অমানবিক দৃশ্যটি মানুষ দেখেছে। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটে প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে তরতাজা তরুণদের পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে নারকীয় উল্লাসের দৃশ্য এখনো মানুষের চোখে ভাসছে। লগি-বৈঠা দিয়ে পৈশাচিক হামলা চালানো ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল। লগি, বৈঠা, লাঠি, পিস্তল ও বোমা হামলা চালিয়ে দিনে দুপুরে জনারণ্যে মানুষ খুন করা হয়েছে। পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যার পর মৃতের রক্তাক্ত লাশের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে উল্লাস নৃত্য করার ঘটনা শত শত ক্যামেরা আর হাজার হাজার মানুষের সামনে ঘটেছে।

২৮ অক্টোবর নিয়ে দেশের মানুষের উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মতোই ঢাকায় বসবাসরত বিদেশিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। তারা নিজেদের শঙ্কার কথা প্রকাশ করছে সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছে। গতকাল মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তিনি জানতে চান আগামী ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে সড়ক বন্ধ করা হবে কিনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘আমাদের এ ধরনের পরিকল্পনা নেই’। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতই নয় ঢাকায় কর্মরত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্তদেশসহ অধিকাংশ কুটনীতিক উদ্বেগে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, বিএনপি মহাসমাবেশকে ঘিরে কোনো নাশকতা বা অঘটন ঘটার শঙ্কা নেই। তবে যদি ঘটে সে আশঙ্কা থেকেই পুলিশের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। তিনি বলেন, চেকপোস্ট বসানো রুটিন ওয়ার্ক। অনেক বহিরাগত ঢাকায় এসে যেন কোনো নাশকতা ঘটাতে না পারে অথবা কেপিআইগুলোতে যাতে কোনো হামলা করতে না পারে সে বিষয়ে আমরা রুটিন মাফিক কাজ করি। রাজধানীতে বেশি চেকপোস্ট থাকায় ও অনেক অভিযান পরিচালনার কারণে ঢাকার পরিবেশ অনেক সুন্দর ও নিরাপদ। মানুষজন স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারছে। আমরা অনেক ছিনতাইকারী, ডাকাত গ্রেপ্তার করছি।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের পাতানো নির্বাচনের পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি কার্যত জনদাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। নির্বাচন কমিশন ফেরেস্তা নয় যে লাখ লাখ কেন্দ্র পাহারা বসাবে। তার এ বক্তব্যে প্রমাণ মেলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি এখনো সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। গতকালও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের তফসিল হবে নভেম্বরের মাঝামাঝি বা তার আগে আর নির্বাচন হবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।’ আওয়ামী লীগের এই নেতার বক্তব্যে প্রমাণ মেলে দলীয় সরকারের অধীনে ভোট হলে ফলাফল কেমন হবে। কারণ খেলার (নির্বাচন) একটি পক্ষ হয়ে তিনি রেফারির মতো খেলার সময় নির্ধারণ করতে পারেন কি? যে কোনো জাতীয় নির্বাচন কখন হবে তা কেবল জানবে নির্বাচন কমিশন। কখন তফসিল ঘোষণা করা হবে এবং ভোট হবে সেটা তাদের কাজ। সরকারি দলের নেতা যদি নির্বাচনে তফসিলের তারিখ ঠিক করে দেন তাহলে ভোটে কি ফলাফল হবে?

বিএনপিসহ এক দফার দাবির আন্দোলনরত দলগুলোতে কার্যত ২৮ অক্টোবর ঘিরে সাজ সাজ অবস্থা। দলগুলো চায় জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প নেই। ওই দিন ঢাকায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ করতে চায় বিএনপি। এজন্য দলটি ইতোমধ্যে সকল ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। সমাবেশকে সামনে রেখে দলটির শীর্ষ নেতারা ধারাবাহিকভাবে সাংগঠনিক বৈঠক করছেন। পাশাপাশি সারা দেশে জেলা এবং বিভাগীয় শহর সফর করছেন। এসব সফরে জেলা ও বিভাগীয় শহরের শীর্ষ নেতাদের সমাবেশের জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে এবং চূড়ান্ত আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। অতীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাস আটকোনো, পরিবহণ মালিক সমিতির সরকারের কথায় বাস ধর্মঘট ইত্যাদি বিষয়ে বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মহাসমাবেশ থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। এজন্যও নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে। তবে এই কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সমাবেশের এক থেকে দুইদিন আগে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে। তাই বিএনপির হাই কামান্ডের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই যাতে নেতাকর্মীরা কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেন তেমন প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে। গতকাল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘২৮ অক্টোবর কমসূচি শেষে যে যার জায়গায় ফিরে যাবে এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওই দিন বসে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি দেওয়া হবে না।’ কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করছে বিএনপি ২৮ অক্টোবর সরকারের পতন ঘটাতে ঢাকার রাজপথে বসে পড়বে। যা সরকারকে বিপদে ফেলতে পারে। সে কারণেই ওবায়দুল কাদের কয়েকদিন আগে হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপি যদি ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বসে পড়ে তাহলে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের যে পরিণতি করা হয়েছিল তাদের সেই পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ তার এই হুমকির মাধ্যমে তিনি কার্যত স্বীকার করে নিলেন যে, ওই সময় শাপলা চত্বরে রাতের আঁধারে সরকার মাদরাসার নিরীহ ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং অনেকে প্রাণ হারিয়েছে।

গতকালও আওয়ামী লীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামী ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। ওই দিন দুপুর ২ টায় এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত শনিবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারির পর বিএনপি মাঠের রাজনীতি করার সুযোগ পায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বিএনপি জেলা, ৮ বিভাগীয় শহর সমাবেশ করে। লাখ লাখ জনতা সে সমাবেশগুলোতে উপস্থিত হন। পরে যুব সমাবেশ, তরুণ সমাবেশ, পেশাজীবী সমাবেশ, পথযাত্রা নানা কর্মসূচি পালন করে। প্রতিটি কর্মসূেিত হাজার হাজার লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটে। রাজধানী ঢাকায় কয়েকটি পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে। প্রতিটি কর্মসূচির দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘শান্তি সমাবেশ’ করে। ওই সব শান্তি সমাবেশগুলোর প্রথম দিকে অশান্তি সৃষ্টি করা হয়। শান্তি সমাবেশের নামে বিএনপির লোকজনকে ঠেকাতে পথে পথে প্রহরা, লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এবং কোথাও কোথাও বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করা হয়।
বিএনপি ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম ঘটাবে। তবে তারা ওই দিন রাজপথে বসে পড়বে না। সেদিন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু আতঙ্কিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের শঙ্কা ২৮ অক্টোবর বিএনপি ঢাকা অবরোধ করতে পারে। সে জন্যই তারাও শান্তি সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। ফলে মুখোমুখি অবস্থান নেয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি কারোই হাতে সময় নেই। ফলে বিএনপি নতুন কর্মসূচি দেয়ার আগেই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিএনপিকে ঠেকাতে শান্তি সমাবেশের নামে লাঠি নিয়ে মোড়ে মোড়ে প্রহরা বসায় কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। ২৮ অক্টোবর নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাপ্রস্তুতি এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্ট বসানো ইত্যাদি জানতে পেরেই পিটার হাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ওই দিন রাস্তা বন্ধ হবে কিনা জানতে চেয়েছেন। তবে দুই দলের উত্তেজনার মধ্যেই ২৮ অক্টোবর কি ঘটে সেদিকে নজর রাখছে আন্তর্জাতিক মহল।

Show More

9 Comments

  1. Do you mind if I quote a few of your posts as long as I provide credit and sources back to your weblog?

    My blog site is in the very same niche as yours and my users would really
    benefit from some of the information you provide
    here. Please let me know if this alright with you. Appreciate it!

    Feel free to visit my homepage; what does vpn mean

  2. Do you mind if I quote a few of your articles as long as I
    provide credit and sources back to your site? My blog site is in the exact same
    niche as yours and my users would genuinely benefit from some of the information you present here.
    Please let me know if this alright with you. Cheers!

    Feel free to visit my web site; vpn special coupon code

  3. You actually make it seem so easy with your presentation but I
    find this matter to be really something that I think I would never understand.
    It seems too complicated and extremely broad for me. I am looking forward for
    your next post, I will try to get the hang of it!

    my web-site … best vpn deals

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button