Hot

অগ্নিকাণ্ড লেগেই আছে, খামখেয়ালি মূল কারণ

বহুতল ভবন, কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বস্তি, বসতভিটাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিনই ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ গত রোববার বিকেলে মহাখালী কড়াইলের গোডাউন বস্তিতে আগুনে ছাই হয়ে গেছে ৬০টি ঘর। একই দিন দুপুরে আগুন লাগে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় টি কে গ্রুপের প্লাইবোর্ড তৈরির কারখানায়। শনিবার ভোরে নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়ার কাঁচাবাজার পুরোটা ভস্মীভূত হয়। এর আগে ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোড ট্র্যাজেডির ক্ষত এখনও শুকায়নি। নিহত ৪৬ জনের পরিবারে এখনও শোকের ছায়া। এবার দেশের নানা প্রান্তে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা বাড়ায় ভয় জাগাচ্ছে আগুনের মৌসুম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগুনের ঘটনায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মূলত খামখেয়ালিপনা ও অব্যবস্থাপনাই তার প্রধান কারণ।

অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে জনমনে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর রেস্তোরাঁর অনিয়ম ঘিরে কয়েক দিন সমন্বয়হীন অভিযান চালায় বিভিন্ন সংস্থা। এখন আবার পুরোনো অনিয়মের বৃত্তে তা চলতে শুরু করেছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারাদেশে যে সংখ্যক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, গত পাঁচ বছর একই সময়ে তা দেখা যায়নি। চলতি বছর গড়ে প্রতিদিন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮৯টি। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৬। এ ছাড়া ঢাকা বিভাগে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটছে; কম বরিশাল বিভাগে। 

প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডে অনেক মানুষের প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বারবার আগুন লেগেছে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদামে। গত শনিবার পুরান ঢাকার চকবাজারের ইসলামবাগে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগে। এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ১২৫ জন এবং ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় মারা যান ৭৯ জন। এ ছাড়া ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ। এতে অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়।

ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৩৭২টি এবং ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ৩৩৪টি। চলতি মাসে ২৫ দিনে ঘটেছে প্রায় তিন হাজার। এ ছাড়া ২০২৩ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার ৬২৪টি। গত বছর অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন ১০২ জন এবং আহত হন ২২১। এ হিসাবে দিনে গড়ে ঘটনা ঘটেছে ৭৬টি। আর ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি দুর্ঘটনা, দিনে গড়ে ৬৬টি। ওই বছর নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। ২০২১ সালে ২১ হাজার ৬০১টি, দিনে গড়ে ৬০টি। ২০২০ সালে ২১ হাজার ৭৩টি, দিনে গড়ে ৫৮টি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ২ হাজার ৬৪৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৭১৩টি ও মার্চে ৩ হাজার ৩৩৪টি। 

আর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ২ হাজার ২৭৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৬০৯ ও মার্চে ৩ হাজার ৮৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ২ হাজার ২৪১টি, ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৩৭৩টি ও মার্চে ২ হাজার ৬৪৪টি দুর্ঘটনা ঘটে। এ পরিসংখ্যানও বলছে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। সেখানে ৬ হাজার ৪১০টি ঘটনা ঘটেছে। আর সবচেয়ে কম ৮০১টি ঘটেছে সিলেট বিভাগে। এ ছাড়া গত বছর রাজশাহীতে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৬০৪টি ও চট্টগ্রামে ৪ হাজার ৪৫৭টি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত শীতের শুষ্ক মৌসুমের সঙ্গে আগুনের একটা যোগসূত্র থাকে। এ কারণে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে অগ্নিকাণ্ড বেশি ঘটে। তবে এর বাইরে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে, এ কারণেও আগুনের ঘটনা বাড়ছে। বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে। আবার বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাসের লাইন থেকে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটছে। অপরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরি, মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারকেও অনেকে দায়ী করছেন।

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান বলেন, শুষ্ক মৌসুমের কারণে আগুনের ঘটনা একটু বেশি ঘটবে। তবে খামখেয়ালি, অবহেলা ও অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি অধিকাংশ ভবন মালিক অহেতুক খরচ মনে করেন। এটি বিনিয়োগ ভাবেন না। তদারকি সরকারি সংস্থাগুলো শক্তভাবে আইনের প্রয়োগ করে না। তাই অনেকে নিয়ম মানছে না। এ ছাড়া আমাদের গ্যাসের ব্যবহার বাড়লেও অনেক লাইন রুগ্‌ণ দশা। এসব কারণে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। বিদেশেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে সেখানে হতাহত হয় কম।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ভবন তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পর তা বসবাসের উপযোগী কিনা, সেটি যাচাই করে সনদ দেবে রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। অনেক ক্ষেত্রে এসব ঠিকঠাক দেখভাল করা হয় না। পয়সা বাঁচাতে সস্তা তার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। এতে বিপদ বাড়ে। অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে সরকারি সংস্থা ছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাবধানতা ও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমাদের মতো দেশে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করতে হয়। তবে অগ্নিনিরাপত্তার ব্যাপারে এ ধরনের সচেতনতা গড়ে তুলতে সরকারি সংস্থার দায়-দায়িত্বে অনেক ঘাটতি আছে। সব ধরনের নিয়ম মেনে ভবন তৈরি না করলেও পার পাওয়া যাবে– এ ধারণা অনেকের মধ্যে আছে। আবার কেউ কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও খামখেয়ালির কারণে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে সামান্য অর্থ খরচ করে না।

ফায়ার সেফটি স্পেশালিস্ট ও বাংলাদেশ গ্রিন বিল্ডিং একাডেমির প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আল ইমরান হোসেন বলেন, অগ্নিনিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা আসেনি। কী ধরনের সরঞ্জাম দিয়ে ভবন তৈরি করা হচ্ছে, তা কেউ দেখভালও করছে না। ২০২১ সালে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা ছিল। এটি আজও হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের উৎসের মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের শর্টসার্কিট, চুলার আগুন, গ্যাসের পাইপ ফেটে যাওয়া, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও কেমিক্যাল। এ ধরনের বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকেই বিদ্যুতের লাইন সঠিক সময়ে চেক করে না। বিদ্যুতের সাব-স্টেশনগুলো ছয় মাসে দু’বার চেক করার কথা। তা সঠিকভাবে করা হয় না। যেখানে-সেখানে বাসাবাড়িতে গড়ে ওঠে রেস্টুরেন্ট। যত্রতত্র কেমিক্যাল মজুত করা হয়। কারখানা তৈরির জন্য যেসব নিয়ম মানা দরকার, অনেকে তা মানেন না। অগ্নিকাণ্ডের পরপরই কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সুপারিশসহ প্রতিবেদন পেশ করলেও তা ফাইলবন্দি থাকে। আবার অনেক কমিটির প্রতিবেদন বছরের পর বছরও আলোর মুখ দেখে না। 

বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ধরন ও তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণে উঠে আসে, অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক গোলযোগ। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সহজেই শর্টসার্কিট হয়ে আগুনের ঘটনা ঘটছে। আবাসিক ভবন ও শিল্পকারখানায়ও এখন আগুন লাগার প্রধান কারণ এ রকম নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার। এসব জায়গায় আগুন লাগার আরেকটি বিশেষ কারণ হলো বিড়ি-সিগারেট, রান্নার চুলা ও বয়লার বিস্ফোরণ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, যে কোনো সূত্র থেকেই যাতে আগুন না লাগে, এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া জরুরি। কোনো অফিস ও শিল্পকারখানায় জ্বলন্ত সিগারেট না ফেলা, আবাসিকসহ সব ধরনের ভবনে ইলেকট্রিক সরঞ্জাম নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। আগুনের ঘটনা টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে শুধু বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৯ হাজার ৮১৩টি। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে আগুনের সূত্রপাত ৪ হাজার ৯০৬টি। ইলেকট্রিক, গ্যাস বা মাটির চুলা থেকে আগুন লাগার ঘটনা ৪ হাজার ১৭৫টি। আর ৪ হাজার ৭৯৬টি অগ্নিকাণ্ডের উৎসই জানা যায়নি। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button