অনিবার্য পতন ঠেকাতে ব্যস্ত ও আতঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র!

‘আমেরিকা যতই শৃঙ্খলা আরোপ করতে চাইবে, ততই বিশৃঙ্খলা ছড়াবে; আর এই বিশৃঙ্খলাই তার আসন্ন পতনের পূর্বাভাস।’
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’ নামে একটি ধারণা উপস্থাপন করেন, যা বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বকে এক মেরু শাসনের রূপ দিতে চেয়েছিল। এই ধারণার মূলে ছিল শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি, যা শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে একটি সুগঠিত বৈশ্বিক কাঠামোর প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই ব্যবস্থার ফলস্বরূপ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বুশ ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে শুরু করেছিলেন এই যাত্রা, যা পরিণত হয়েছিল লাখ লাখ মৃত্যুর ট্র্যাজেডিতে। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অজুহাতে এই হস্তক্ষেপ ইরাক, আফগানিস্তান, ইউক্রেন, চেচনিয়া, জর্জিয়া থেকে শুরু করে লিবিয়া, সোমালিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’র সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈপরীত্য হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক তাদের পুরনো মিত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান ও কসোভোতে হস্তক্ষেপ সব ক্ষেত্রেই তাদের নীতি ছিল দ্বিমুখী এবং স্ববিরোধী। বুশ, বারাক ওবামা এবং জো বাইডেন একই কণ্ঠে শান্তির বার্তা দিলেও তাদের শাসনামলে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপে দেশগুলো আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ধারা থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে চেয়েছিলেন বলে দাবি করলেও তার নীতিগত দ্ব্যর্থতা এবং আগ্রাসী অবস্থান বিশ্বে নতুন নতুন সঙ্ঘাতের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্পের প্রশাসন এক বছরের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি দেশে বোমাবর্ষণ করে, যা এই অঞ্চলে তীব্র অস্থিরতা তৈরি করে। ‘আব্রাহাম চুক্তি’ নামে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি উদ্যোগে ফিলিস্তিনকে উপেক্ষা করে তারা এক ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিচ্যুতি ঘটায়, যার পরিণতিতে আজ গাজায় মানবিক বিপর্যয় চলমান।
বিশ্বজুড়ে এই মার্কিন হস্তক্ষেপ এবং কৌশলগত বিপর্যয়ের প্রতিফলন কেবল মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় দেশগুলোও মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের মন্তব্য সেই উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ, যা ওয়াশিংটন ও ইউরোপের সম্পর্ককে নতুন সঙ্কটে ঠেলে দেয়।
এছাড়া, ইউরোপের প্রতি মার্কিন অবজ্ঞা, ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি এবং আমেরিকার চরম আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ইউরোপকে অপমানিত করেছে। পশ্চিমা নেতৃত্বের মধ্যে এই টানাপোড়েন, একদিকে ইসরাইলের যুদ্ধকে সমর্থন এবং অন্যদিকে ট্রাম্পের তোষামোদ করে যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই গোটাটাই একটি ধ্বংসাত্মক ধারার প্রতিফলন। আমেরিকা যতই নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে চায়, তাদের পদক্ষেপ ততই বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দিচ্ছে। ক্ষমতার নেশা, পুঁজিবাদের লোভ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক বিচ্যুতি সব মিলিয়ে মার্কিন নেতৃত্ব আজ এক গভীর সঙ্কটে নিপতিত।
বিশ্ব এখন একটি গর্ডিয়ান নটের (সমাধানহীন জটিল গিঁট) সামনে দাঁড়িয়ে, যেটি কেবলমাত্র একটি দৃঢ় ও বিপ্লবী নেতৃত্বের তরবারি দ্বারা কাটা সম্ভব। কিন্তু এই নেতৃত্ব কোথা থেকে আসবে এবং কখন আসবে, তা অনিশ্চিত। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ছাঁটাই, একাডেমিক মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ভুল বিশ্লেষণ মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রকে অকার্যকর করে তুলছে।
আজ এই ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছর পর এটি স্পষ্ট যে ব্যবস্থাটিতে ফাটল ধরেছে। এটি সম্পূর্ণভাবে কখন ধসে পড়বে বা তার পরে বিশ্ব কিভাবে এগোবে, তা কেউ জানে না। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, এটি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। ‘আমেরিকা যতই শৃঙ্খলা আরোপ করতে চাইবে, ততই বিশৃঙ্খলা ছড়াবে; আর এই বিশৃঙ্খলাই তার আসন্ন পতনের পূর্বাভাস।’