অর্থনীতির সংকট আমলে নেওয়া দরকার
টাকার বিপরীতে ডলারের দর পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটলে এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকলে ভালো থাকবে না অর্থনীতির প্রকৃত খাত (কৃষি-শিল্প-সেবা)। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল, যা এখন নেই। এ কারণে জিনিসপত্রের দাম, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ, ঋণ পরিশোধ, রপ্তানি বাণিজ্যসহ যেসব বিষয়ে চ্যালেঞ্জ, অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা রয়েছে– তা আমলে নিতে হবে। কোনোভাবেই সরকারকে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে হবে না। এখন যেসব বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা আমলে নিয়ে দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। আর নির্বাচনের পর যেতে হবে বড় ধরনের সংস্কারে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেকশোরে বাংলাদেশ উন্নয়ন অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনের প্রথম দিনের একটি অধিবেশনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এমনই মতামত তুলে ধরেন। ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং বাংলাদেশের নীতি-বিকল্প’ শিরোনামে জনবক্তৃতা দেন আহসান মনসুর।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে এখন রয়েছে চ্যালেঞ্জ; আছে অনিশ্চয়তা। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শঙ্কাই এখন বড় শঙ্কা। নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে রপ্তানি খাতের কী হবে– সেটাই বড় প্রশ্ন। অর্থনীতির সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকরা এখন একাকার। তাদের মধ্যে পার্থক্য নেই। নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীরা এভাবে মিশে গেলে সংস্কার সম্ভব হবে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের হাতে ব্যাংক, পত্রিকা, টেলিভিশন। তারা নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলছে। ব্যাংকে একই পরিবার থেকে পরিচালক সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
পরিচালকদের মেয়াদ করা হয়েছে টানা ১২ বছর। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার চলছে উল্টোরথে। তাঁর মতে, সামগ্রিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব সংকট তৈরি হয়েছে, এর পেছনে ভুল নীতিও রয়েছে। বিনিময় হার দীর্ঘদিন ধরে রাখায় রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে। এখন আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ না এলে তো ঘাটতি হবেই। বর্তমানে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, তাতে হতাশাগ্রস্ত হওয়া যাবে না; বরং আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পতন এবং দেশের আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি-বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা দরকার বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ঋণ পরিশোধে যাতে ব্যর্থ হতে না হয়, এ জন্য প্রয়োজনে ঋণদাতাদের সঙ্গে বৈঠক করে পরিশোধের সময় বাড়াতে হবে। দায় কীভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে, এ জন্য তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বিদেশি ঋণ বিশেষত স্বল্পমেয়াদি ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করা যাবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। তিনি নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে বলেন, পাওনাদারদের সঙ্গে বসেন; সিঙ্গাপুর যান, দুবাই যান। তাদের সঙ্গে কথা বলেন। কোথাও প্রয়োজন হলে ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় নিন। কিন্তু কোনোভাবেই ‘ফেল’ করা উচিত হবে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ঋণ পরিশোধে খেলাপি হওয়ার রেকর্ড নেই।
তিনি বলেন, রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। এ অবস্থায় নিকট মেয়াদে দায় পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। তবে কী পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নিকট মেয়াদে পরিশোধ করতে হবে– এর প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না। বেসরকারি খাতে এখন স্বল্পমেয়াদি ঋণের স্থিতি আছে ১২ বিলিয়ন ডলার; জ্বালানি খাতে চার বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে এলসির পরিশোধ রয়েছে, বিদেশি কোম্পানির ডিভিডেন্ড পরিশোধসহ আরও কিছু পরিশোধ রয়েছে। সুতরাং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার।
সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করবেন না। এমনভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে, যাতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার ও বিনিময় হার এক জায়গায় রেখে দিয়ে যে ভুল করেছে, এর প্রভাবে এখনকার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বেসরকারি খাত অনেক কম সুদে ঋণ নিয়ে এখন বেশি সুদে পরিশোধ করছে। আবার বিনিময় হার এত বেড়েছে, শুধু এ কারণেই তাদের এক লাখ কোটি টাকা বাড়তি গুনতে হবে। তাঁর মতে, অর্থনীতিতে এখন যে সংকট, এর জন্য শুধু করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই দায়ী নয়; এতে অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার দায়ও রয়েছে।
আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত চিত্র আরও খারাপ। এ খাত খুবই অগভীর। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র কাগজ-কলমের চেয়ে অনেক বেশি। ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি এখন ৮ শতাংশের নিচে, যা ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ ছিল। এভাবে সঞ্চয় কমে গেলে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়বে কীভাবে– প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তাঁর মতে, সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত কম, যা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নির্ভর করে রাজস্ব সংগ্রহের ওপর। বাংলাদেশে রাজস্ব ও বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ৪০০ শতাংশের মতো, যা উদ্বেগজনক। এর কারণ, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ; যা যে কোনো দেশের মধ্যে কম। এ অবস্থা থেকে বের হতে ব্যাপক কর সংস্কার দরকার। কর প্রশাসন ও কর নীতি আলাদা করা দরকার। কর না বাড়ালে টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে পিআরআইর চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার বলেন, বাংলাদেশে অন্তত ২৫ বছর সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ছিল। তবে করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে শুধু সতর্কতার বার্তা দেওয়া উচিত হবে না। অর্থনীতিতে অনেক ইতিবাচক দিকও আছে, যা তুলে ধরতে হবে।
আলোচনায় আরও অংশ নেন অর্থনীতিবিদ ড. সাজ্জাদ জহির, বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. কাজী ইকবাল, পিআরআইর সিনিয়র ইকোনমিস্ট ড. আশিকুর রহমান প্রমুখ।