অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্ক কাঠগড়ায় ওঠাল গাজা যুদ্ধ
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অষ্টম মাসে গড়িয়েছে। এরই মধ্যে উপত্যকাটিতে ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। বলা হচ্ছে, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সংঘাতগুলোর একটি চলছে গাজায়।
প্রাণহানির পাশাপাশি গাজার মানবিক সংকটও চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমন পরিস্থিতিতে চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন দেশটির প্রগতিশীল ও ফিলিস্তিনপন্থী অনেক অধিকারকর্মী।
দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ওয়াশিংটন। ইসরায়েলকে প্রতিবছর প্রায় ৩৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেয় তারা। এ ছাড়া গত বছরের ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর পর থেকে ইসরায়েলকে অতিরিক্ত শত শত কোটি ডলারের সহায়তা দিয়েছে দেশটি। ওই সহায়তা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার কাজে লাগানো হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই এককাট্টা সমর্থনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে মুখর হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকা অস্ত্র উৎপাদনকারীসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
এই শিক্ষার্থীদের একজন ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের পোমোনা কলেজের সিনকি চ্যাপম্যান। এই কলেজের চত্বরে তাঁবু খাটিয়ে বিক্ষোভ করার কারণে গত মাসে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। চ্যাপম্যান তাঁদেরই একজন। তাঁদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল—ইসরায়েল ও গাজায় হামলার সমর্থন দেওয়া সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করা।
চ্যাপম্যান বলেন, ‘ভবিষ্যতে গিয়ে যখন পেছনে ফিরে তাকাব, দেখতে পাব, আমরা ইতিহাসে সঠিক পক্ষেই ছিলাম। আর শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা ইসরায়েল–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের যে দাবি তুলেছিলেন, তার জবাব দিতে ২০৯ দিন অপেক্ষা করার জন্য কলেজ প্রশাসনের হাত রক্তে লাল হয়ে থাকবে।’
স্নায়ুযুদ্ধ ঘিরে শুরু যে সম্পর্ক
দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ গবেষণা খাতকে সহায়তা করে আসছে দেশটির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এই সম্পর্কের প্রভাব নিয়ে বহু আগে থেকেই উদ্বেগ রয়েছে। যেমন ১৯৬১ সালে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার শিক্ষা খাতে সামরিক শিল্পের প্রবেশের বিপদ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড্যানিয়েল বেসনার আল–জাজিরাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্কের উত্থানের পথ তৈরি করে দিয়েছিল গত শতকে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ।
১৯৫৭ সালে বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ—‘স্পুতনিক’ উৎক্ষেপণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের চেয়ে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে ওয়াশিংটন। পরের বছরই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স এডুকেশন অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন পাস করা হয়। ফলে যুদ্ধের সঙ্গে একপ্রকার জড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও।
গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ চলছে
ড্যানিয়েল বেসনার বলেন, প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার স্বাক্ষর করে সেটাকে আইনে পরিণত করেছিলেন। যদিও তিনিই আবার পরে এই আইনের সমালোচনা করেছিলেন। ওই আইনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালা শুরু করে দেশটির প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন।
শিক্ষাবিদ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে এই সম্পর্কের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে ক্যালিফোর্নিয়া। প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ গবেষণা খাতের জন্য এই অঙ্গরাজ্যটির পরিচিতি রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার বিজনেস অ্যান্ড ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট অফিস জানিয়েছে, ২০২১ অর্থবছরে সেখানকার প্রতিরক্ষা শিল্প খাতে আয় হয়েছে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।
আন্দোলনের ইতিহাস বহুদিনের
ক্যালিফোর্নিয়ায় ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস পুরোনো। সেই ধারাবাহিকতা আজও চলছে। অঙ্গরাজ্যটির শিক্ষার্থীরা এর আগেও ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের প্রতি মার্কিন সমর্থন ও ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছেন তাঁরা।
পোমোনা কলেজের শিক্ষার্থী সিনকি চ্যাপম্যান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের একমাত্র কারণ হলো, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গাজায় গণহত্যায় (জাতিগত নিধন) সহায়তা করছে ও প্ররোচনা দিচ্ছে। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের সময় তারা তহবিল দিয়ে সহায়তা করেছিল।’
ক্যালিফোর্নিয়ার অনেক শিক্ষার্থীই তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দানের অর্থে গঠিত লাখ লাখ ডলারের তহবিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব তহবিল আসে প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে বিনিয়োগকৃত দানের অর্থের মুনাফা থেকে। তহবিল দেওয়ার অর্থ হলো—বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন দীর্ঘমেয়াদে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে।
এই প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্প খাতের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত বিভাগের। আন্দোলনকারীরা বলছেন, এই বিভাগগুলোয় গবেষণা প্রকল্প, নিয়োগ, চাকরি মেলা ও অনুদানের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে অস্ত্র নির্মাতা ও মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার হার্ভে মাড কলেজের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘মাডার্স এগেইস্ট মার্ডার্সের’ এক সদস্য পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতো নিরপেক্ষ পরিচয় দিয়ে তারা আসে। সরাসরি অস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত এমনটা প্রকাশ করে এই প্রভাব খাটানো হয় না।
সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান
অনেকেই আবার প্রতিরক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ফলাও করে প্রচার করে। যেমন সান্তা বারবারার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইসিএসবি) ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স সেন্টার। অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেথিয়নের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ককে নিজেদের ওয়েবসাইটে তারা ‘সফলতার গল্প’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অধিভুক্ত বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে অস্ত্র নির্মাতা রেথিয়ন, নর্থরোপ গ্রুম্যান, বোয়িং ও লকহিড মার্টিনের নাম রয়েছে। আর ২০২২–২৩ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১০ লাখ ডলার অনুদান দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় রয়েছে লকহিড মার্টিন ছাড়া ওপরের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এই সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে আল–জাজিরার কাছে কোনো মন্তব্য করেনি রেথিয়ন। তবে অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সমর্থন করে বলছে, এটি একটি অংশীদারত্বের সম্পর্ক, যার মধ্য দিয়ে দুই পক্ষই উপকার পাচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা মূল্যবান অভিজ্ঞতার সুযোগ পাচ্ছে, অপরদিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে এমন বক্তব্যে বিশ্বাস করেন না অনেকে। অস্ত্র নির্মাতা ও সরকারি প্রতিরক্ষা কার্যক্রম থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দূরে থাকার দাবি তুলেছেন তাঁরা। সান্তা ক্রুজের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসাবেল কাইন তাঁদেরই একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রিসার্চার্স এগেইনস্ট ওয়্যার’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি।
বিগত সপ্তাহগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন বিক্ষোভ হচ্ছে। এসব কর্মসূচি থামাতে লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ইউসিএলএ) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মারমুখী হয়েছে পুলিশ। ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন ইসরায়েলপন্থীরাও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে গ্রেপ্তার ও বহিষ্কার করা হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে।
পরের প্রজন্মের ওপর প্রভাব
বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামরিক বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকে তাদের একটি বৃহৎ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওই প্রচেষ্টার মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইঞ্চি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্র্যাফটের গবেষক বেঞ্জামিন ফ্রিম্যান বলেন, ‘আপনি যেদিকেই তাকাবেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব দেখতে পাবেন। এই শিল্প খাতের আকার বিশাল। তারা যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আসে, তখন সেখানকার মেধাকে ভিন্ন দিকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলে।’
উদাহরণ দিতে গিয়ে বেঞ্জামিন ফ্রিম্যান বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন খাতে কাজ করার বদলে তরুণ ও উদীয়মান শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি এমন সব প্রতিষ্ঠানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যাদের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে অস্ত্র তৈরি।’